Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 1:27 pm

মদ-সিগারেট বিক্রির ১৩৩ কোটি টাকা শুল্ককর পরিশোধ করা হয়নি

রহমত রহমান: পাঁচ বছর ধরে আমদানি করা করেছে শুল্কমুক্ত সুবিধার মদ ও অ্যালকোহল জাতীয় পণ্য। এতে প্রযোজ্য শুল্ককর ১৩৩ কোটি টাকার বেশি। এই শুল্ককর করা হয়নি পরিশোধ। শুধু তা-ই নয়, ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড সুবিধায় আমদানি করা সেই পণ্য নিয়ম মেনে সরবরাহ করা হয়নি। কোনো নন-প্রিভিলেজ পার্সন ও নন-ডিপ্লোম্যাটিক ব্যক্তির কাছে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়েছে তারও কোনো হিসাব নেই।

দৈনিক বা মাসিক বিক্রির নেই কোনো রেজিস্টার। ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড সুবিধায় মদ ও অ্যালকোহল জাতীয় পণ্য আমদানি ও সরবরাহের ক্ষেত্রে ঢাকা ওয়্যার হাউস লিমিটেডের বিরুদ্ধে এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দিয়েছে।

অপরদিকে, এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা ওয়্যার হাউস থেকে প্রযোজ্য শুল্ককর আদায় করার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে এনবিআর থেকে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এনবিআরকে এই বিষয়ে জানাতে বলা হয়েছে। তবে নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বন্ড কমিশনারেট কোনো তথ্য নিরীক্ষা দলের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি। এক্ষেত্রে কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন এনবিআরে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্র মতে, ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা সিগারেট, মদ ও অ্যালকোহল জাতীয় পণ্য আমদানি করা হয়। কিন্তু এসব পণ্যের কোনো সঠিক হিসাব থাকে না। প্রিভিলেজ ও নন-প্রিভিলেজ পারসনদের কাছে বিক্রি করা হলেও তার কোনো রেজিস্টারে তা লিপিবদ্ধ করা হয় না। পরিশোধ করা হয় না প্রযোজ্য শুল্ককর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব মদ ও মাদক জাতীয় পণ্য বিক্রি করে দেয়া হয় খোলাবাজারে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর শুল্ককর উদঘাটনে কম্প্রিহেনসিভ পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট করার সিদ্ধান্ত নেয় এনবিআর। এরই অংশ হিসেবে মেসার্স ঢাকা ঢাকা ওয়্যার হাউস লিমিটেডের কম্প্রিহেনসিভ পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট শেষ করে প্রতিবেদন দিতে কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটকে ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয় এনবিআর। ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৫ বছরের নিরীক্ষার নির্দেশনা দেয়া হয়। সে অনুযায়ী চলতি বছরের ২ জানুয়ারি এনবিআরকে কাস্টমস মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরীক্ষা শেষ করতে কাগজপত্র চেয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তিনবার চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো কাগজপত্র সরবরাহ করা হয়নি। পরে কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন গেলে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠান পণ্যের ইন-টু-বন্ড রেজিস্টার ব্যবহার করলেও এক্স-টু-বন্ড রেজিস্টার ব্যবহার করেন না। তবে কম্পিউটারে সফটওয়্যারে বিক্রয়ের হিসাব রাখেন বলে জানান। যদিও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কম্পিউটারে সফটওয়্যার বিক্রয়ের তথ্য দেখাতে পারেননি। শুধু ইন-টু-বন্ডের কিছু ফটোকপি দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বিক্রয়ের বিপরীতে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি নন-ডিপ্লোম্যাটিক ও নন-প্রিভিলেজড পারসন এবং প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের কাছে সিগারেট ও মাদকদ্রব্য বিক্রি করেছে তার কাস্টমস পাসবুক, ফরেন মিনিস্ট্রি কর্তৃক ডিপ্লোম্যাটিক ও প্রিভিলেজড পারসনের নামে ইস্যু করা ‘অব্যাহতি সনদ’-এর সত্যায়িত কপি নিরীক্ষা দলকে দিয়ে সহযোগিতা করেননি।

প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা ইন-টু-বন্ড রেজিস্টারে হিসাব ও ‘ওরাল বিজনেস ইন্টিলিজেন্স সফটওয়্যার’-এর আমদানি তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ৫ বছরে ৩০ লাখ ৫৮ হাজার ৯০১ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে। এই আমদানি করা পণ্য প্রতিষ্ঠানটির ইন-টু-বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি পাওয়া গেলেও কেবল সিগারেটের ক্ষেত্রে বিল অব এন্ট্রিতে পণ্যের নিট ওজন কেজিতে উল্লেখ আছে। কিন্তু ইন-টু-বন্ডে উল্লেখ আছে কার্টন, মিনি কার্টন, স্টিক হিসেবে। ফলে প্রতি কার্টনে কত পিস সিগারেট রয়েছে তা স্পষ্ট নয়। প্রতিষ্ঠানের কাছে সিগারেট ও মদ বিক্রির হিসাব চেয়ে বারবার চিঠি দেয়ার পরও কোনো হিসাব দেয়নি। একইভাবে তথ্য চেয়ে প্রতিষ্ঠানের লিয়েন ব্যাংকে চিঠি দেয়ার পরও কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।

অপরদিকে, ঢাকা ওয়্যার হাউসের সব তথ্যাদি চেয়ে বন্ড কমিশনারেটকে কয়েক দফা চিঠি দেয়। কিন্তু বন্ড কমিশনারেট থেকে সব তথ্য দেয়া হয়নি। বিশেষ করে কাস্টমস পাস বুকের তালিকা, মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স কর্তৃক ইস্যুকৃত ডিপ্লোম্যাটিক ও প্রিভিলেজড পারসন, প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যাহতি সনদ দেয়া হয়নি। যার ফলে পুরো নিরীক্ষা শেষ করতে পারেনি। ওরাল বিজনেস ইন্টিলিজেন্স সফটওয়্যারের তথ্যানুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে ৫৫টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে প্রায় ৮ লাখ লিটার মদ ও প্রায় ১০ হাজার কেজি সিগারেট আমদানি করেছে। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ২১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার মদ ও দুই হাজার ৬৩০ কেজি সিগারেট আমদানি করেছে। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ৩০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে সাড়ে ৪ লাখ লিটার মদ ও ২ হাজার ৮১১ কেজি সিগারেট আমদানি করেছে। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ২৪ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ৩৩টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ লিটার মদ আমদানি করেছে, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ২৯ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ২২টি বিল অব এন্টির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার মদ আমদানি করেছে, যাতে শুল্ককর প্রায় ২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৬১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ২৫ লাখ ৬ হাজার ৪৫৯ লিটার মদ ও ১৫ হাজার ১৯১ কেজি সিগারেট আমদানি করেছে। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ১৩৩ কোটি ৪১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৭ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান এই মদ ও সিগারেট কোথায়, কীভাবে, কাদের কাছে বিক্রি করেছে-তার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। এতে প্রমাণিত হয়, প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে এসব মদ ও সিগারেট শুল্ককর ফাঁকি দিতে বিক্রি করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠান থেকে প্রযোজ্য এই শুল্ককর আদায় ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

অপরদিকে, কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার ১৫ জানুয়ারি নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দিয়েছে এনবিআর। যাতে বলা হয়, প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি শুল্কমুক্ত মদ ও অ্যালকোহল যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সরবরাহ করেনি। নন-প্রিভিলেজড ও নন-ডিপ্লোম্যাটিক ব্যক্তির কাছে শুল্ককর পরিশোধপূর্বক পণ্য বিক্রয়ের সব তথ্য অডিট টিমকে দেখাতে পারেননি। এ ছাড়া দৈনিক ও মাসিক বিক্রি ইত্যাদির তথ্য কোনো রেজিস্টারে সংরক্ষণ করেনি। প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহ ও পরবর্তী বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তথ্য নিরীক্ষা দলের কাছে উপস্থাপনে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছেন। প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানি করা পণ্যের যথাযথ বিক্রয় বা সরবরাহ দলিলাদি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় আমদানি তথ্যাদি বিবেচনায় নিয়ে এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে নিরীক্ষিত সময়ে পরিহার করা রাজস্বের পরিমাণ ১৩৩ কোটি ৪১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৭ টাকা। প্রতিষ্ঠান থেকে পরিহার করা এই রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এনবিআরকে অবহিত করতে অনুরোধ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরীক্ষার জন্য কাস্টমস মূল্যায়ন থেকে তথ্য ও দলিলাদি চেয়ে একাধিকবার বন্ড কমিশনারেটকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বন্ড কমিশনারেট এই প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত কোনো দলিলাদি সরবরাহ করেনি। এ বিষয়ে কমিশনারের বক্তব্য বা মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের এক্স-টু-বন্ড রেজিস্টার ব্যবহার করে না এবং পণ্য বিক্রয়ের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রমাণক দলিলাদি উপস্থাপন করতে পারেনি। নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠানটির সুপারভাইজড ক্লিয়ারেন্স ব্যবস্থার অধীনে পণ্য সরবরাহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেখানে একজন বন্ড কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানে পদস্থ থেকে সুপারভাইজড ক্লিয়ারেন্স তদারকি করেন। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় বা সরবরাহের বিপরীতে প্রমাণক দলিলাদি বা এক্স বন্ড রেজিস্টার ইত্যাদি উপস্থাপনে ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নিরীক্ষিত সময়ে এই প্রতিষ্ঠানে পদস্থ বন্ড কর্মকর্তাদের দায় নিরূপণ করে গাফিলতি পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ-সংবলিত প্রতিবেদন এনবিআরে প্রেরণের অনুরোধ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঢাকা ওয়্যার হাউসের ব্যবস্থাপক আলাউদ্দিনের ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে ফোন দেয়া হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। কাস্টমস মূল্যায়ন যে প্রতিবেদন দিয়েছে সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। তবে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।