মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা

আল আমিন আল রাব্বি: মুসলিম দেশগুলোয় কলহ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ অবস্থা সংকটময় বিরোধের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। ফিলিস্তিন, গাজা-ইসরাইল ইস্যু, সৌদি-ইয়েমেন ইস্যু ও রাজনৈতিকভাবে রেষারেষি এখন সারা বিশ্বই প্রত্যক্ষ করছে। ফলে বৈশ্বিক শান্তি রক্ষায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে এ রাষ্ট্রগুলোর স্থিতিশীল অবস্থান জরুরি হয়ে পড়েছে।

মুসলিম দেশগুলোয় পারস্পরিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সাহায্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে গড়ে উঠেছিল ওআইসি। কিন্তু সেই ওআইসির তেমন কার্যতৎপরতা এখন পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো নয়। আরব বসন্তের পর আরবের দেশগুলোয় যে রাজনৈতিক কোন্দল শুরু হয়েছে, সেখানে ওআইসি তেমন কোনো বড় ভূমিকা রাখতে পারেনি। অথচ রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও পারস্পরিক প্রতিবেশীসুলভ আচরণ বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করেই এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা হয়।

১৯৬৯ সালে ইসরাইলের হাত থেকে আল-আকসা মসজিদের নিরাপত্তাকে উপলক্ষ করেই ওআইসির জš§ হয়। অথচ ইসরাইল-ফিলস্তিনিদের সেই বিবাদ কিছুদিন পরপরই খবরের মূল শিরোনাম হয়ে ওঠে। আরবের দেশগুলোয় স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে ওআইসির ভুমিকা ম্রিয়মাণ। ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মীর, লিবিয়া ও আফগানিস্তানে যে রাজনৈতিক কোন্দল বিদ্যমান, তার সমাধানের লক্ষ্যে ওআইসির মতো সংস্থার তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

আরবের দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে আরব লীগ। সেই আরব লীগও আজ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ এই বেহাল অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সুগঠিত অর্থনীতি এবং সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী মুসলিম দেশের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাদের হাত ধরে আরবে ফিরে আসবে স্থিতিশীলতা।

সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইরান এই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে মধ্যপ্রাচ্যে একটা স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সৌদি আরবের অবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী। বিশ্বের অনেকাংশ তেলের জোগান দিয়ে থাকে সৌদি আরব। জ্বালানিশক্তির নির্ভরশীলতাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদির প্রভাব লক্ষণীয়। অন্যদিকে ইরানকে আরব কান্ট্রি হিসেবে ধরা না হলেও আরবের রাজনীতিতে ইরানের প্রভাব লক্ষণীয়।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান একটা ফ্যাক্টর। ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের জন্য হুমকি মনে করে। তাদের নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তাই তারা ইরানের ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য ইসরাইলকে ব্যবহার করছে। সিরিয়ার আসাদ সরকারকে ইরান সমর্থন দিয়ে আসছে। এর বিপরীতে ইসরাইল আসাদবিরোধী দলকে আগে থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের হামাসকে ইরান অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আগে থেকেই সহযোগিতা করে আসছে। সেদিক থেকে তেহরান থেকে লেবাননের স্থল করিডোরের নিরাপত্তার জন্য ইরান সিরিয়ার রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাবক হিসেবে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে ইরানও রাজনীতির মোড় ঘোরানোর মতো শক্তি রাখে।

অন্যদিকে রয়েছে তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের বন্ধুত্ব বহু পুরোনো। ১৯৫২ সালে এশিয়ার একমাত্র দেশ তুরস্কই ন্যাটোতে যোগ দেয়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক পরস্পরের সমালোচনা করলেও নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক বন্ধুত্বে তারা সচল। সিরিয়া, ইরান ও ইরাকÑএই তিনটি দেশই তুরস্কের সীমান্তে অবস্থিত। সিরিয়ার কুর্দিদের উত্থান ও সিরিয়ার শহর ইদলিবের শরণার্থীদের তুরস্ক গমন সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তুরস্ককে টেনে নিয়ে এসেছে। সিরিয়ার সরকারের বিরোধী পক্ষকে তুরস্ক সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রয়োজন ছিল সহযোগী একটি রাষ্ট্র। সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিপরীত সিরিয়ার আসাদ সরকারকে রাশিয়া ও ইরান তাদের সমর্থন দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছে আগে থেকেই। তবে ২০০৩ সালে তুরস্কের নতুন সরকার রিসেফ তাইয়েপ এরদোগানের উত্থানের পর তুরস্ক অর্থনীতি, সামরিক শক্তি ও অভ্যন্তরীণ উন্নতি করেছে এবং আরবীয় অঞ্চলের মুরব্বিতে পরিণত হয়েছে। এরদোগানের উত্থানের পর রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে। তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক  সম্পর্ক এবং ডলারের বিপরীতে তুরস্কের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থায় আদান-প্রদানের চিন্তা যুক্তরাষ্ট্র তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ দেখছে। সিরিয়ায় কোন্দল ও রাশিয়া-ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তুরস্ক এখন একটা বড় ফ্যাক্টর এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তুরস্ক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অনেক চুক্তিতেও মধ্যস্থতা করেছে তুরস্ক। সেদিক থেকে ন্যাটোভুক্ত দেশ ও মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে তুরস্কও একটি শক্তিশালী ভিত্তি নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে।

কয়েক দিন ধরে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। ৮ মে থেকে শুরু করে ১২ মে পর্যন্ত এই হামলা চলমান ছিল। এতে গাজা উপত্যকায় ৩৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। রকেট নিক্ষেপের কারণে আরও কিছু অঞ্চলে হতাহতের খবর পাওয়া যায়। ইসরাইল কর্তৃক ফিলস্তিনের হামলার ঘটনা বিশ্বের মানুষের জন্য নতুন কিছু নয়। কিছুদিন পরপরই আল আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলিদের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সময়ে-অসময়ে এভাবে ফিলস্তিনিদের ওপর যে নিপীড়ন চালানো হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের বড় বড় দেশ, যেমনÑযুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, রাশিয়া, এমনকি জাতিসংঘেরও তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। তাদের প্রতিবাদ শুধু নিন্দা জানানো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। অথচ ফিলস্তিন-ইসরাইল ইস্যু কত পুরোনো একটি ইস্যু। গাজা উপত্যকায় প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস। ফিলিস্তিনবাসী ও গাজাবাসীদের এরকম বিপন্ন জীবনযাপন দীর্ঘদিন ধরেই হুমকিতে রয়েছে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল আরব লিগ ও ওআইসি। বিশ্ব যেখানে নীরব, জাতিসংঘ, আরব লিগ ও ওআইসি যেখানে ব্যর্থ, সেখানে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ ইরান, সৌদি আরব, মিসর ও তুরস্কের সমন্বিত প্রচেষ্টাই ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যুতে একটা স্থিতিশীলতা নিয়ে আসার সম্ভাবনা রাখে। কেননা এই দেশগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে কর্তৃত্ব করার যোগ্যতা রাখে। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে এই দেশগুলো এগিয়ে আসতে পারে।

শিক্ষার্থী

আরবি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০