নাজমুল ইসলাম ফারুক ও নিয়াজ মাহমুদ: চলতি বছরে ব্যবসায়িক মন্দার কবলে পড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২০ কোম্পানি। এতে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে গেছে কোম্পানিগুলো। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অচিরেই এ মন্দা কাটানো নিয়েও রয়েছে সংশয়। তাই এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তথ্যমতে, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজার থেকে চার কোটি ৫০ লাখ শেয়ারের মাধ্যমে ১৫৭ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ৩৫ টাকা নেওয়া হয়, যার মধ্যে প্রিমিয়ামের নামে ২৫ টাকা নেওয়া হয়েছিল। উত্তোলিত অর্থ দিয়ে ব্যাংকঋণ পরিশোধ, অবকাঠামো উন্নয়নে খরচ করার কথা ছিল। পুঁজিবাজার থেকে প্রতিষ্ঠানটি তালিকাভুক্তির আগে বেশ ভালো মুনাফায় ছিল প্রতিষ্ঠানটি। অথচ তালিকাভুক্তির দুই বছর পরই সুশাসন পরিপালনে ব্যর্থ হয়ে প্রতিষ্ঠানটি ‘এ’ থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে আসে। লেনদেনের প্রথম অবস্থায় কোম্পানির শেয়ারদর ৬৩ টাকার ওপরে ছিল। গত এক মাসে কোম্পানির শেয়ারদর সর্বনিম্ন ২৪ টাকা ৯০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ২৮ টাকা ৪০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে।
ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের কোম্পানি সচিব শাহাদাত হোসেন সুশাসন পরিপালনে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা সময়মতো বার্ষিক সাধারণ সভা করতে পারিনি। তাই কোম্পানিটি ‘এ’ থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে এসেছে। আদালতের অনুমতি নেওয়ার পরপরই আমরা এজিএম করবো। তখন আবারও কোম্পানিটি আগের পজিশনে চলে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
অন্যদিকে সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। ১০ টাকার ফেস ভ্যালুতে তালিকাভুক্তির পরই প্রতিষ্ঠানটি মালিকানা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে ব্যবসা মন্দার দিকে ধাবিত হয়। অর্থ উত্তোলন করে কোম্পানিটি লাভবান হলেও লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বঞ্চিত হলেন বিনিয়োগকারীরা। দুই বছর আগে কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ৩৪ টাকা ৪০ পয়সা। গত সপ্তাহেও কোম্পানিটির শেয়ারদর ফেস ভ্যালুর নিচে ছিল।
সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব এসকে সাহা শেয়ার বিজকে বলেন, গত এজিএমে হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত থাকায় ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রায় ১০ মাস কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। একই সঙ্গে গাজীপুরে কারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ না পাওয়ায় ডিজেলে উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটি লোকসানে রয়েছে। কাক্সিক্ষত লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে চলে গেছে। তবে শিগগিরই কোম্পানিটি পিভিসি পাইপের বাণিজ্যিক উৎপাদন কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে। পণ্যটি বাজারজাত হলে কোম্পানিটি লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
শুধু ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ও সুহৃদই নয়, এমন ২০টি প্রতিষ্ঠান সুশাসন পরিপালনে ব্যর্থ এবং ব্যবসা মন্দার কারণে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে মেট্রো স্পিনিং মিলস, ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস লিমিটেড, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, প্রাইম ফাইন্যান্স, ফাস্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড, বিডি ওয়েল্ডিং ইলেক্টোডেস, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, পিপলস লিজিং, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, বিচ হ্যাচারি লিমিটেড, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেড, সোনারবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার লিমিটেড, ঢাকা ডায়িং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড, বঙ্গজ লিমিটেড ও তাল্লু স্পিনিং মিলস লিমিটেড। এর মধ্যে সরাসরি ‘এ’ থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে এসেছে ১২টি কোম্পানি। বাকি আটটি ‘বি’ থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে এসেছে।
এসব কোম্পানির সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানায়, বিভিন্ন কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক মন্দায় পড়েছে। এর মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যা, রফতানি কমে যাওয়াসহ অন্যান্য কারণে লোকসানে পড়ে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিচ হ্যাচারির লোকসান ও লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার কারণ সম্পর্কে কোম্পানি সচিব নুরুল ইসলাম বলেন, রিজার্ভ ট্যাংকার বন্ধ থাকার কারণে বর্তমানে আমাদের কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এ বছর আর চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম। সাধারণত জানুয়ারি-জুন আমাদের উৎপাদন মৌসুম। এ সময়ে শেয়ারহোল্ডাররা আশানুরূপ মুনাফা পাচ্ছেন না।
আগামী বছরের শুরুতে আবার কারখানা চালু করা হবে বলে আশা প্রকাশ করে তারা বলেন, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার মহেশখালীপাড়া এলাকায় ৯ দশমিক ২ একর জমির ওপর কোম্পানির হ্যাচারি। কোম্পানিটি চিংড়ির পোনা উৎপাদন ও বিপণন করে।
এদিকে তাল্লু স্পিনিং মিলস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে তাল্লু স্পিনিংয়ের সম্প্রসারিত নতুন প্রকল্পের বাণিজ্যিক উৎপাদন? শুরু করে। ১০ হাজার ৮০টি উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন স্পিন্ডলেসের নতুন এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে কোম্পানিটির কটন সুতা উৎপাদন বছরে ১৫ লাখ কেজি বাড়বে বলে জানায় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
কোম্পানিটি ব্যাংক বা অন্য কোনো ধরনের ঋণ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ জন্য ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কোম্পানিটি আশা করেছিল এর ফলে বার্ষিক লেনদেন ৪২ কোটি টাকা বাড়বে। অন্যদিকে মুনাফা বাড়বে বার্ষিক সাড়ে তিন কোটি টাকা। কিন্তু উৎপাদন শুরুর বছরেই লোকসানে পড়েছে কোম্পানিটি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে আশাহত হয়েছেন শেয়ারহোল্ডাররা।
এ সম্পর্কে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ফিরোজ ইসতেখার মাসুদ শেয়ার বিজকে বলেন, উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাড়নো যায়নি। প্রোডাকশন লসের (উৎপাদন ব্যাহতের) কারণে বিদায়ী বছরে লোকসানে পড়তে হয়েছে। ফলে বৃহস্পতিবারের পর্ষদ সভায় শেয়ারহোল্ডারদের ‘নো ডিভিডেন্ড’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, যেসব কোম্পানি সুশাসন পরিপালন করতে পারে না, এজিএম সময়মতো করতে পারছে না, আর্থিক প্রতিবেদন সময়মতো জমা দিতে পারছে না, লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ, উৎপাদন কম সেগুলোকেই ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন অনেক কোম্পানি আছে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এমন অনেক কোম্পানিই পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে ঋণ পরিশোধ করছে। তালিকাভুক্ত হওয়ার দু-এক বছর ভালো লভ্যাংশ দেয়। পরবর্তী সময়ে বোনাস দিলেও একসময় প্রতিষ্ঠানগুলো লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়। তাই আইপিওতে কোনো কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়ার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত ভালো করে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া।
Add Comment