মো. রবিউল আউয়াল রবি, ময়মনসিংহ: কোনোভাবে কমছে না শিল্পকারখানার দূষণ। ইটিপি থাকলেও স্বাভাবিক থাকছে না কেমিক্যালের প্যারামিটার। দূূষিত বর্জ্য সরাসরি খাল বা নদীতে চলে যাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্যের। ঠিক এমনই অবস্থা শিল্পাঞ্চল বলে খ্যাত ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ভরাডোবা গ্রামের পাকিস্তানি এক্সপেরিয়েন্স টেক্সটাইল মিলের। এই মিল থেকে নিঃসরণকৃত দূষিত বিষাক্ত বর্জ্যে অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে দুই হাজার একর ধানি জমি। এতে করে এক যুগ ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও ওই এলাকার প্রায় ছয় গ্রামের দরিদ্র কৃষকরা। পরিবেশ দূষণরোধে ২৪ ঘণ্টা ইটিপি চালু রাখার কথা থাকলেও নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছেন না কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে ওই মিলের বর্জ্য মিশ্রিত দূষিত পানি নিঃসরণ বন্ধের দাবিতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও আন্দোলন করেও কোনো প্রতিকার পায়নি কৃষকরা। এ কারণে এখন এক রকম হাল ছাড়ার মতো অবস্থা।
স্থানীয় এলাকাবাসীরা জানান, উপজেলার ভরাডোবা ও বিরুনীয়া ইউনিয়নের কাহাচূড়া বিল, হাউড্ডা বিল, খুরুলিয়া বিল, সাধুয়া বিল, ভালুকজানি বিল, গায়লা বিল রয়েছে। আরও রয়েছে তালতলা বিল, কেচুরগোনা বিল, তেইরা বিল, শিমুলিয়া বিল, সাউত্তার কুড়ি, তৌরা বিল, ডিমাইল বিল, মলেঙ্গা বিল, বালিপাথর বিল প্রভৃতি। সব মিলিয়ে এসব জলাশয়ের প্রায় দুই হাজার একর জমিতে এক্সপেরিয়েন্স টেক্সটাইল (পাকিস্তানি) মিলের বর্জ্য নিঃসরণ হচ্ছে এক যুগ ধরে। ফলে ওই এলাকার কৃষকরা তাদের জমিতে ধান রোপণ করতে পারছেন না।
স্থানীয়রা আরও জানান, সারা বছরই বিলগুলোয় দূষিত পানি থাকে। দীর্ঘদিন যাবৎ ধান রোপণ না করতে পারায় সব বিল কচুরিপানায় ভরে গেছে। এতে দুটি ইউনিয়নের প্রায় ছয়টি গ্রামের কৃষক তাদের জমিতে ধান চাষ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে।
এছাড়া এসব বিলে সারা বছর নানা প্রজাতীর মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু মিলের বিষাক্ত পানির কারণে এখন আর কোনো মাছ নেই। বিলের পানিতে নামলে শরীর চুলকানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ।
জমিতে দীর্ঘদিন ধরে কালো পানি জমে থাকায় যেমন মাটি হারিয়েছে তার উর্বরতা, ঠিক তেমনি জীববৈচিত্র্য হচ্ছে ধ্বংস। আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত মানুষের বাড়ির টিউবওয়েলের পানি থেকেও আসে দুর্গন্ধ। অনেকে তাদের পুরোনো টিউবওয়েলের পানি খেতে পারছেন না।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন বর্জ্য কোনো কারখানা থেকে নিঃসরণ হলে তা জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কয়েকবছর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি দল সরেজমিন পরিদর্শন করে নানা অভিযোগ এনে মিল কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিক কারখানা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়া দুই কোটি ২৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করেন ও ইটিপি ত্রুটিমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মিল বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু কয়েকদিন মিলটি বন্ধ থাকলেও পরবর্তী সময়ে রহস্যজনক কারণে আবার তা চালু হয়। এতে ফের দূষিত পানির জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ফসলহানি শুরু হয়।
পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা বলছেন, এই দূষিত বর্জ্যরে কারণে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে ওই এলাকার কৃষকরা কোনো ফসল ফলাতে পারছেন না। বিষাক্ত পানির কারণে জলাশয়ে কোনো মাছ নেই। ফসল ও জীববৈচিত্র্যের এত ক্ষতিসাধনের পরও বহাল তবিয়তে কীভাবে কারখানাটি চলমান রয়েছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
স্থানীয় কৃষক ইব্রাহিম খলিল জানান, আমরা দীর্ঘ এক যুগ ধরে এক মুঠো ধান বাড়িতে নিতে পারছি না। আমার বাবার পাঁচ একর জমি থাকার পরও আমাদের চাল কিনে খেতে হয়।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলম তরফদার জানান, এরা আমার ইউনিয়নবাসীকে ধ্বংস করে ফেলেছে। আমি পরিবেশ অধিদপ্তরে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি।
পাকিস্তানি এক্সপেরিয়েন্স টেক্সটাইল মিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার পরও তারা বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
এ বিষয়ে ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা খাতুন জানান, আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। কৃষকদের এ করুণ অবস্থার কথা আমি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানিয়েছি। আশা করছি, ফসলহানির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের পরিচালক ফরিদ আহম্মেদ বলেন, এই কারখানাকে আমাদের পরিবেশের কোনো ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। তারা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে কারখানা পরিচালনা করছে।