রবিউল আউয়াল রবি, ময়মনসিংহ: অনুমোদন ছাড়া দুটি প্যাকেজ একসঙ্গে করে একটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা, এলিভেটর কেনায় একটি করে প্যাকেজ থাকলেও কোনো দরপত্র আহ্বান না করা, পণ্য কেনায় সাতটি প্যাকেজের মধ্যে একটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা এবং ফাউন্ডেশনের নকশা পরিবর্তন করাসহ সরকারি ক্রয় আইন না মেনে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ময়মনসিংহ জেলা সমাজসেবা কমপ্লেক্স নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্প। সেইসঙ্গে সঠিকভাবে প্রকল্প তৈরি না হওয়ায় বাস্তবায়নে হয়েছে ধীরগতি। চলতি বছর জুনের শেষ দিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, এতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ রয়েছে। প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে কি না, তা জানতে চাওয়া হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরডিপিপিতে (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ২২ জেলায় পূর্ত কাজের প্রতিটি ভবনের অনুকূলে দুটি করে প্যাকেজ থাকলেও বাস্তবে শুধু কুমিল্লা ছাড়া সব জেলায় অনুমোদন ছাড়া দুটি প্যাকেজ একসঙ্গে করে একটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এতে ডিপিপি এবং পিপিআর-২০০৮-এর বিধি ১৭ ব্যত্যয় ঘটেছে। জুনের মধ্যে সব আসবাব, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ক্রয় কার্যক্রম সম্পন্ন করার কথা থাকলেও সমীক্ষাকালীন ১০ জুন পর্যন্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। পণ্য কেনার সাতটি প্যাকেজের মধ্যে একটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এছাড়া এলিভেটর কেনার জন্য একটি করে প্যাকেজ থাকলেও সমীক্ষাকালীন চলতি বছরের জুন পর্যন্ত লিফট কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
অনুমোদিত আরডিপিপি অনুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদে (প্রজেক্ট কো-অরডিনেটর, নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী) জনবল নিয়োগ না দেয়ায় নির্মাণ কাজের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হচ্ছে। তাই ২০১৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটির গত জুনের মধ্যে ভৌত কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব না হওয়ায় মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পটি যথাসময়ে শেষ না হওয়ার প্রধান কারণ, ডিপিপি অনুযায়ী সময়মতো দরপত্র আহ্বান করতে না পারা এবং ডিপিপি আরডিপিপি অনুযায়ী বছরভিত্তিক আর্থিক ও ভৌত কাজের পরিকল্পনা প্রস্তুত না করা। ফাউন্ডেশনের নকশা পরিবর্তন, ভবনের দিক পরিবর্তনের নকশা প্রাপ্তিতে সময় বিলম্ব এবং করোনা মহামারির কারণে পাঁচ থেকে ছয় মাস কাজ বন্ধ থাকায় নির্মাণকাজে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। তবে প্রকল্পের শুরুতে যথাযথভাবে বেজলাইন সার্ভে ও ফিজিবিলিটি স্টাডি করে ডিপিপি আরডিপিপি প্রণয়ন করা হলে সমস্যাগুলো আগেই জানা যেত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আইএমইডি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত (এডিপি) উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কিছু নির্বাচিত চলমান প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা ও সমাপ্ত প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা প্রতিবেদন করে। এরই ধারাবহিকতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর বাস্তবায়নাধীন ৬৪ জেলায় ছয়তলাবিশিষ্ট জেলা সমাজসেবা কমপ্লেক্স নির্মাণ (প্রথম পর্যায় ২২ জেলা) (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পটি নিবিড় পরিবীক্ষণের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টেকনোকনসাল্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ১৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ ভেরিয়েশন করা হয়েছে। ভেরিয়েশন অনুমোদনের জন্য প্রকল্প দপ্তরের প্রাক্কলন পাঠানো হয়েছে। গত ২৭ মে পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির) সভায় ভেরিয়েশন অনুমোদনের জন্য পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ে মে পর্যন্ত একবার অডিট হয়েছে। অডিটে দুটি অডিট আপত্তি ছিল। আপত্তির জবাব অডিট অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে, যার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। প্রকল্পের প্রধান অংশ ভবন নির্মাণ কাজের বিষয়ে পূর্ত অডিট সম্পাদিত হয়েছে। অপরদিকে ময়মনসিংহ জেলা সমাজসেবা কমপ্লেক্স নির্মাণে ময়মনসিংহ গণপূর্ত বিভাগের ভূমিকা নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে দুটি অডিট আপত্তি রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ময়মনসিংহে নির্মাণাধীন ভবনের নির্মাণকাজে ব্যবহƒত ইটের মান (আকৃতিগত ও কোনা ভাঙা) সন্তোষজনক নয়। শাটারিং সঠিক না হওয়ায় এবং ভাইব্রেটর মেশিন ঠিকমতো ব্যবহার না করায় কিছু ক্ষেত্রে কাজে হানিকম্ব (ওয়াল ফুলে ওঠা) দেখা গেছে। শ্রমিকদের হ্যান্ড গ্লাভস, গাম্বুট, হ্যালমেট প্রভৃতি সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা হয়নি। দরজার জন্য ব্যবহƒত কয়েকটি চৌকাঠে চির দেখা গেছে। এছাড়া প্লাস্টার-পরবর্তীকালে দেয়ালের অনেক জায়গায় সাদা লোনা ভেসে উঠেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদে ১১ প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে ১২তম প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের মধ্যে মহাপরিচালক নভোথিয়েটার, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসাবে ছয়বার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
জেলা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুজ্জামান চুন্নু শেয়ার বিজকে জানান, আমরা আইএমইডির প্রতিবেদনটি দেখেছি, সেখানে দুটি অডিট আপত্তি রয়েছে, যা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। আর ভবন নির্মাণে ত্রুটি নেই, আর থাকলেও এখনও তো আমরা ভবন বুঝে নিইনি।
প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলো উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিজিবিলিটি স্টাডি ও বেজলাইন সার্ভে না করা, সময়মতো দরপত্র আহ্বান করতে না পারা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং নিয়মিত পিআইসি ও পিএসসি সভা না করা। জেলা পর্যায়ের কর্মরত মা ও শিশুদের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির কথা উল্লেখ থাকলেও তাদের জন্য ভবনে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়নি, যা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়া প্রতিবন্ধীদের জন্য বাথরুমে রেলিং বা হ্যান্ডেল দেয়া হয়নি।
প্রকল্প পরিচালক ড. অঞ্জন কুমার দেব রায় শেয়ার বিজকে বলেন, আমি আইএমইডির প্রতিবেদনটি এখনও দেখিনি। আর নি¤œমানের কাজের কিছুই নেই, কাজ করতে গেলে একটু-আধটু সমস্যা থাকতেই পারে।