বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল কাঁচামরিচ। এর নানা দিক নিয়ে আজকের আয়োজন মরিচের চাষাবাদ
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল মরিচ। এটি শুধু খাবারের স্বাদই বাড়ায় না, বরং এর ভিটামিন মানবদেহের জন্য বেশ উপকারী। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে মরিচের চাষ করা হয়।
জলবায়ু ও মাটি
সাধারণত রবি মৌসুমে বেশি চাষ করা হয়। পর্যাপ্ত সূর্যের আলো ও বাতাস রয়েছে, পানি সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধা রয়েছে এমন দোআঁশ মাটি মরিচ চাষের জন্য ভালো। তবে জৈব পদার্থসমৃদ্ধ দোআঁশ বা পলি দোআঁশ মাটি মরিচ চাষের জন্য তুলনামূলক বেশি উপযুক্ত।
জাত
ঝাল ও মিষ্টি দু’ধরনের মরিচ রয়েছে। ঝাল মরিচের মধ্যে বগুড়া, চাঁদপুরী, ফরিদপুরী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কামরাঙ্গা, ধানে মরিচ, আকালী ও কালো মরিচের জাত রয়েছে। এগুলোর ঝাল তুলনামূলক বেশি।
জমি তৈরি ও রোপণ পদ্ধতি
প্রথমে একটি জমিতে মরিচের বীজ ছিটিয়ে চারা তৈরি করতে হবে। শীতকালের জন্য ভাদ্র-আশ্বিন ও বর্ষা মৌসুমের জন্য ফাল্গ–ন-চৈত্রে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। এরপর যে জমিতে চারা লাগানো হবে, সে জমি কয়েকবার মই দিয়ে চাষ করতে হবে। এ সময় জৈবসার ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে মেশাতে হবে। চারা ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হলে রোপণের উপযোগী হবে। চারা রোপণের আগে আগাছা পরিষ্কার করে আবার তিন থেকে চারবার চাষ দিয়ে চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার রাখতে হবে। চারা বিকালে লাগাতে হবে। চারা লাগানোর পর তিন থেকে চার দিন সকাল-বিকাল পানি দিতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা
মরিচের জমিতে গোবর, ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার ছিটিয়ে দিতে হবে। চারা রোপণের ২৫ দিন বা এক মাস পর ইউরিয়া ও এমওপি সার ছিটিয়ে দিতে হবে। এর দুই মাস পর দ্বিতীয় ও ৭০ দিন পর তৃতীয় কিস্তিতে সার দিতে হবে।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা
জমিতে রসের অভাব হলে সেচ দিতে হবে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। শুকনো মৌসুমে তুলনামূলক বেশি সেচের প্রয়োজন। পানির অভাবে ফলন কমে যেতে পারে। আগাছা হলে নিড়ানি দিয়ে তা পরিষ্কার করতে হবে। সার দেওয়ার সময় কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আলগা করে নিতে হবে। মরিচ মাটিবাহিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তাই একই জমিতে বারবার মরিচ চাষ করা ঠিক নয়।
সংরক্ষণ
মরিচের রঙ লাল হলে গাছ থেকে তুলে রোদে শুকাতে হবে। তবে সাবধানে তুলতে হবে, যাতে মরিচের বোঁটা খুলে না যায়। মাচা করে মরিচ শুকানো উচিত। শুকানোর পর টিনের ডোল, গোলা, পলিথিন বা ড্রামে রাখতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এসব পাত্রে যেন বাতাস না ঢোকে। আর শুকানো মরিচ যেন স্যাঁতসেঁতে জায়গায় না রাখা হয়।
পোকামাকড় ও রোগবালাই থেকে মুক্তি
মরিচ উৎপাদনে প্রধান প্রতিবন্ধক রোগবালাই ও পোকামাকড়। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এর ফলন বাড়ানো যাবে। মরিচের কিছু রোগবালাই ও পোকামাকড় থেকে প্রতিকারের উপায় জেনে নিতে পারেন
ঢলে পড়া বা গোড়া পচে যাওয়া
মূলত মাটি ও পানির কারণে মরিচ গাছ ঢলে পড়ে কিংবা এর গোড়া পচে যায়। কম নিষ্কাশনযুক্ত ভেজা মাটি এজন্য দায়ী। ফলে বপনের পর বীজ পচে যেতে পারে অথবা চারা মাটি থেকে ওঠার আগে মারা যেতে পারে। বীজ অঙ্কুরোদ্গমের পর কচি চারার গোড়ায় পানিভেজা দাগ পড়ে ও পরে কুঁচকে গিয়ে চারা ঢলে পড়ে মারা যায়।
প্রতিকার: পানি নিষ্কাশনের সুবিধা রয়েছেÑএমন উঁচু বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজ বপনের দুই সপ্তাহ আগে বীজতলা শোধন করে নিতে হবে। বীজ শোধন না করে বপন করা যাবে না। কৃষি দফতরের পরামর্শ নিয়ে ছত্রাকনাশক ওষুধ প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছের গোড়ার মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
আগা মরে যাওয়া ও ফল পচা

গাছের পরিত্যক্ত অংশের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। আর্দ্র আবহাওয়া ও অতিরিক্ত বৃষ্টি এ রোগ বিস্তারের জন্য দায়ী। মরিচ গাছের নতুন ডগা, ডাল, ফুলের কুঁড়ি, ফল এ রোগে প্রথম আক্রান্ত হয়। গাছের আক্রান্ত অংশ যেমন পাতা, কাণ্ড ও ফল ক্রমে ওপর থেকে ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে। এতে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে ও ফল ধরার ধারণক্ষমতা কমে যায়। আক্রান্ত ফল ঝরে পড়ে।
প্রতিকার: সুস্থ ও সবল ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। প্রোভেক্স ২০০ বা ব্যাভিস্টিন দিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। গাছের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা ও আশেপাশের ধুতুরাজাতীয় গাছ ধ্বংস করতে হবে।
পাতা পচা
উচ্চ তাপমাত্রা বা স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়াÑদুই-ই এ রোগের জন্য দায়ী। চারা ও বয়স্ক গাছের শাখা-প্রশাখা, পাতা, ফুল-ফল আক্রান্ত হয়। প্রথমে পাতায় পানি ভেজা দাগ পড়ে। পাতা দ্রুত পচতে থাকে। আক্রান্ত গাছের ওপর থেকে নিচের দিকে পচন ধরে। পাতা ও ডাল কালো হয়ে যায় এবং কদিন পর গাছ মরে যায়।
প্রতিকার: ফসলের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে অতিরিক্ত সেচ দেওয়া যাবে না। গাছ আক্রান্ত হওয়া মাত্রই ছত্রাকনাশক ওষুধ ব্যাভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে এক গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
জাব
এ পোকা গাছের কচি পাতা ও ডগার রস খায়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। পাতার মধ্যে এ পোকা বাস করে। খুব ছোট ও সাদা রঙের হয়ে থাকে।
প্রতিকার: দ্রুত আক্রান্ত অংশ সরিয়ে ফেলতে হবে। এ সময় মরিচ ক্ষেতে শুকনো ছাই ছিটিয়ে দিতে হবে। নিয়মিত পানি স্প্রে করতে হবে। তামাকের গুঁড়ো, সাবানের গুঁড়ো ও নিমপাতার রস পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করলে পোকা দূর হয়।
সাদা মাছি
খুব ছোট আকারের এ পোকা পাতার রস চুষে খায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তাছাড়া এ পোকা কালো সুটি মোল্ড নামের ছত্রাক জš§াতে সহায়তা করে। সাদা রঙের এ পোকা গাছের পাতার নিচের দিকে অবস্থান করে। এরা পাতা চুষে খায়। এ কারণে পাতা কুঁচকে যায়। এছাড়া শিরাসহ পাতা হলুদ হয়ে যায়।
প্রতিকার: হলুদ রঙের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া পানিতে কাপড় কাচা সাবান মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। কৃষি দফতরের পরামর্শ অনুযায়ী কীটনাশক স্প্রে করতে পারেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাঁচামরিচ পাউডার
অর্থকরী ফসল কাচামরিচ। ফসলটি পচনশীল। উৎপাদন মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে কাঁচামরিচ বাজারে পাওয়া যায়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হওয়ায় এ মৌসুমে কাঁচামরিচের দাম তুলনামূলক কম থাকে। এ কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। অনেক সময় কৃষক একই জমিতে অন্য শস্য চাষের জন্য মরিচ পাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় না। আবার বর্ষাকালে পাকা মরিচ শুকানো বেশ কষ্টকর। তাই তাদের বাধ্য হয়ে কম দামে কাঁচামরিচ বিক্রি করতে হয় অথবা ফেলে দিতে হয়। এছাড়া সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ ও পরিবহন সুবিধার অভাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে কাঁচামরিচ নষ্ট হয়।
উল্লিখিত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করে কাঁচামরিচের মূল্যসংযোজিত পণ্য তৈরি করা হলে সংরক্ষণজনিত সমস্যার সমাধান হবে এবং কৃষককে আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে। কৃষক তাদের পণ্যের ক্ষতি হ্রাসের পাশাপাশি উপযুক্ত দাম পেলে পরবর্তী সময়ে উৎপাদন ও ফলন বাড়াতে উৎসাহ পাবে। আর্থিকভাবেও তারা লাভবান হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) গবেষণায় দেখা গেছে, কাঁচামরিচের পাউডারের পুষ্টিগুণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুকনো মরিচের পুষ্টিগুণ অপেক্ষা অনেক বেশি। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, শুকনো মরিচের পাউডার পেটে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে মানবদেহের জন্য প্রতিদিন অল্প পরিমাণে কাঁচামরিচ খাওয়া উচিত।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীন মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা একাধিকবার কাঁচামরিচের পাউডার ও কাঁচামরিচের পেস্ট (যা সচরাচর তরকারিতে ব্যবহার করা হয়) পাশাপাশি দুটি তরকারিতে ব্যবহার করে সন্তোষজনক ফল পেয়েছেন। কোনো কেমিক্যাল বা প্রিজারভেটিভ ব্যবহার ছাড়াই কাঁচামরিচের রঙ অটুট রেখে এর পাউডার উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক ড. মো. মাসুদ আলম প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দুবার গবেষণার জন্য বিশেষ অনুদান পেয়েছিলেন। তাছাড়া সারা বছর প্রক্রিয়াজাত মরিচ সহজলভ্য হলেও ভোক্তারা তুলনামূলক কম দামে এ ধরনের প্রক্রিয়াজাত কাঁচামরিচ কিনতে পারবেন। প্রক্রিয়াজাত কাঁচামরিচ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। সে সঙ্গে বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানও হবে।
পাউডার প্রস্তুত প্রণালি
# কাঁচামরিচের বোঁটা ফেলে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে
# মরিচগুলো ৯০ থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটিয়ে হালকা সিদ্ধ করতে হবে
# এরপর ৫০ থেকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ড্রায়ার কিংবা সূর্যের আলোয় শুকিয়ে মচমচে করতে হবে
# শুকানো মরিচ ব্লেন্ডার বা গ্র্যান্ডিং মেশিনে গুঁড়ো করলে কাঁচামরিচের পাউডার পাওয়া যাবে।
সংরক্ষণ
# মরিচের পাউডার ঠাণ্ডা করে পলি প্যাক বা কাচের বায়ুনিরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
সুবিধা
# শুষ্ক অবস্থায় কাঁচামরিচের গুঁড়ো এক বছরের অধিক সময় সংরক্ষণ করে তরকারিতে ব্যবহার করা যাবে
# অন্তত এক মাস আগে কাঁচামরিচ সংগ্রহ করে অন্য ফসলের জন্য জমি প্রস্তুত করা যায়
# দ্রুত পচন থেকে মরিচ রক্ষা করা যায়।
ব্যবহার
সব ধরনের রান্নায় কাঁচা কিংবা শুকনো মরিচের বিকল্প হিসেবে কাঁচামরিচের পাউডার ব্যবহার করা যাবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা
কাঁচামরিচের পাউডার প্যাকেটজাত করে বিপণন করতে পারবেন।
আবিদ হোসেন বুলবুল, গাজীপুর