সৃষ্টিশৈলীর অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনা দ্বিতীয় হাসান মসজিদ। আটলান্টিক মহাসাগরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পানিতে ভাসমান দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি। একে ভাসমান মসজিদ বলার কারণ মসজিদটির তিন ভাগের এক ভাগ আটলান্টিক মহাসাগরের ওপরে। দূরের কোনো জাহাজ থেকে দেখলে মনে হয় ঢেউয়ের বুকে যেন মসজিদটি দুলছে আর মুসল্লিরা যেন নামাজ পড়ছেন পানির ওপর।
এ মসজিদটির অবস্থান মরক্কোয়। এটি আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ও পৃথিবীতে সপ্তম বৃহৎ। উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে থাকা অপূর্ব একটি স্থাপত্য। ঝড়-বৃষ্টি ছাড়া প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস প্রবেশ করে মসজিদটির ছাদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায় তিন মিনিট পরপর। প্রায় ৩৩ ফুট উচ্চতার সামুদ্রিক ঢেউ সামাল দিতে পারে মসজিদটি। সমুদ্রের কোনো গর্জন শোনা যায় না মসজিদটির ভেতর থেকে। মুসলিম বিশ্বের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে, ঠিক আটলান্টিক মহাসাগরের তীর ঘেঁষে এর অবস্থান।
মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন মরক্কোর বাদশাহ দ্বিতীয় হাসান। তার নামানুসারেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়। মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কা একটি বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক শহর। ঘনবসতিপূর্ণ হাজার হাজার দালান-কোঠার ভিড়ে দৃষ্টিনন্দন কোনো স্থাপনা এখানে নেই। তাই আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি মরক্কো, বিশেষ করে ক্যাসাব্লাঙ্কার জন্য একটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মসজিদ নির্মাণে সিদ্ধান্ত নেন।
মসজিদটির নকশা করেন বাদশাহ হাসানের ফরাসি স্থপতি মিশেল পিনচিউ। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। প্রাথমিকভাবে ১৯৮৯ সালে রাজার ৬০তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে মসজিদটির উদ্বোধন করার লক্ষ্য থাকলেও সেটি সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৩ সালে এর উদ্বোধন করা হয়। ২২ দশমিক ২৪ একর জায়গার ওপর এর অবস্থান।
মসজিদটি আয়তাকার। যেখানে নামাজ পড়া হয়, সেটি একটি বিশালাকৃতির ভবন। এর দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার, প্রস্থ ১০০ মিটার। ভূমি থেকে ছাদ পর্যন্ত উচ্চতা ৬০ মিটার, যা প্রায় ১৭ তলার সমান। আয়তাকার হলের ছাদটি ৭৮টি বিশালাকৃতির স্তম্ভের ওপর স্থাপিত। এটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আড়াই হাজার পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর ভেতরে প্রায় ২৫ হাজার ও বাইরে ৮০ হাজার মানুষ এক সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে। নারীদের নামাজের জন্য পৃথক একটি বারান্দা রয়েছে, যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার নারী নামাজ পড়তে পারে।
মসজিদটির কিছু অংশ মাটির ওপর, বাকিটা পানির ওপর ভাসমান। ভাসমান অংশের মেঝের কিছু স্থান কাঁচের তৈরি। এখান থেকে মসজিদের নিচে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার দৃশ্য উপভোগ করা যায়। একটি মাদরাসা, গোসলখানা, জাদুঘর, একটি কনফারেন্স হল ও একটি সুবিশাল লাইব্রেরি রয়েছে। শুধু মাদরাসাটি চার হাজার ৮৪০ বর্গমিটারের বিশাল ভূমির ওপর। মাদরাসা, কনফারেন্স হল ও লাইব্রেরির কক্ষগুলোয় অত্যাধুনিক অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তি রয়েছে। এছাড়া ৪১টি সুসজ্জিত পানির ফোয়ারা আছে। এর আশেপাশে সাজানো হয়েছে ১২৪টি পানির ঝরনা দিয়ে। মসজিদের কেন্দ্রীয় হলের ছাদটি দু’পাশে সরে গিয়ে উম্মুক্ত হতে সক্ষম। তিন হাজার ৪০০ বর্গমিটার আকারের ছাদটির এক হাজার ৭৫০ বর্গমিটারই উম্মুক্ত হতে পারে। এক হাজার ১০০ টন ওজনের ছাদটি একটি মোটরের সহায়তায় খুলে যেতে সময় নেয় মাত্র পাঁচ মিনিট। ছাদটি বন্ধ থাকা অবস্থায় ৫০টি ঝাড়বাতি হলটিকে আলোকিত করে রাখে, যাদের কয়েকটির ব্যাস ছয় মিটার, উচ্চতা ১০ মিটার ও ভর ২০০ কেজি। দিনের বেলা ছাদটি খুলে দেওয়া হলে মুসল্লিরা খোলা আকাশের নিচে সূর্যের আলোয় আলোকিত হলঘরে নামাজ আদায় করতে পারেন। রাতে চাঁদ ও তারার আলো রুমের চারপাশের দরজাগুলো থেকে রুমটিকে আলোকিত করে রাখে।
মসজিদের মিনারটি বর্গাকৃতির। ২১০ মিটার উঁচু মরক্কোর সবচেয়ে উঁচু ভবন, যা প্রায় ৬০ তলা ভবনের সমান। ৬০ তলা ভবনের সমান এ মিনারের ওপরে রয়েছে লেজার রশ্মি, যা নাবিকদের দেখিয়ে দেয় পবিত্র কাবা শরিফের পথ। ৩০ কিলোমিটার দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায় এই লেজার রশ্মি। এটি সবুজ, গাঢ় সবুজ ও নীল রঙের টাইলস দ্বারা সুসজ্জিত। মিনারটির উচ্চতার জন্য বিশেষ ধরনের কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণ কংক্রিটের চেয়ে চারগুণ শক্তিশালী। ফলে প্রচণ্ড বাতাস ও ভূমিকম্পে কোনো সমস্যা হবে না। শহরের যে কোনো স্থান থেকে মিনারটি দেখা যায়।
মসজিদটিতে ইসলামিক ও মরোক্কান স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণ রয়েছে। এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন বিখ্যাত মসজিদ ও ইসলামিক স্থাপত্যের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। ভেতর ও বাইরের অসাধারণ কারুকাজের প্রায় পুরোটাই হস্তশিল্পের। দৃষ্টিনন্দন মোজাইক, পাথর আর মার্বেলের মেঝে, স্তম্ভ ও খোদাইকৃত কাঠের নকশার কাজ করা। গ্রানাইট, মার্বেল, প্লাস্টার, কাঠসহ বেশিরভাগ নির্মাণসামগ্রী মরক্কো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশেষ কিছু গ্রানাইটের নির্মিত স্তম্ভ ও ৫০টি ক্রিস্টালের ঝাড়বাতির বেশিরভাগ ইতালির ভেনিস থেকে আনা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কোথাও কোথাও এসব মোড়ানো হয়েছে স্বর্ণের পাত দিয়ে। বিশ্বের অধিকাংশ মসজিদ থেকে ভিন্ন এটি।
মসজিদটি পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। পর্যটকদের জন্য আরবি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষায় গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা রয়েছে। এই ট্যুরের আওতায় নামাজের হল, ভূগর্ভস্থ অজু করার স্থান ও হাম্মামখানা দেখানো হয়। মসজিদে প্রবেশ করতে দর্শনার্থীদের শালীন ও সম্মানজনক পোশাক পরিধান করতে হয়। নারীদের জন্য তাদের হাঁটু ও হাতের কনুই পর্যন্ত ঢাকা থাকতে হবে। সব ধর্মাবলম্বী এখানে প্রবেশ করতে পারেন। মসজিদের চারপাশের ফুলের বাগান পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। পারিবারিক পিকনিকের জনপ্রিয় স্থান হিসেবেও বাগানের পরিচিতি রয়েছে।
ইন্টারনেট অবলম্বনে শিপন আহমেদ