নাজমুল হুসাইন: মাংস ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিলের নামকরা ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে গরু-খাসির মাংসের কোনো পদ রান্না হয়নি। খাবারের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে তেহারি-কাচ্চি-খিচুড়ি। যদিও এসবই জনপ্রিয় পদের খাবারেই ভর করে চলে ফখরুদ্দিন। কিন্তু গতকাল রেস্তোরাঁটিতে মুরগির মাংসের দু-এক পদের খাবার ছিল। শুধু ফখরুদ্দিনই নয়, সেখানে হাজী, হানিফসহ কয়েকটি নামকরা রেস্তোরাঁ একই অবস্থায় চলেছে। ছয় দিনের এ ধর্মঘট চলবে আগামী শনিবার পর্যন্ত।
সরেজমিনে দেখা যায়, ধর্মঘটের প্রথম দিন (সোমবার) কিছু সুপারশপে মাংস পাওয়া গেলেও গতকাল থেকে রাজধানীর কোথাও মাংস পাওয়া যাচ্ছে না। গরু জবাইসহ প্রতিটি দোকান এখন বন্ধ। বন্ধ রয়েছে বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় মাংস সরবরাহ। এতে হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকসহ ক্রেতারা মাংস না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন।
এদিকে গতকাল ভালোবাসা দিবস থাকায় রেস্তোরাঁ মালিকদের বাড়তি প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু এ অবস্থায় তাদের ক্ষতিতে পড়তে হয়েছে। টানা এভাবে ধর্মঘট চলতে থাকলে শুধু মাংসকেন্দ্রিক তেহারি-কাচ্চি-খিচুড়ির দোকানগুলো লোকসানে পড়বে এমনটা জানিয়ে ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘মাংসের অভাবে বসন্ত আর ভালোবাসা দিবসের আয়োজন সম্পন্ন করা যায়নি। হঠাৎ এমন ধর্মঘটে বাড়তি প্রস্তুতিও নেওয়ার সুযোগ হয়নি। মাংস সরবরাহকারীরা মাংস দিচ্ছেন না। এ অবস্থায় কাচ্চি-তেহারির রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ রাখতে হবে। কারণ এসবই আমাদের মূল খাদ্যপদ।’
তিনি বলেন, ‘ভালোবাসা দিবসে এখানে কোনো গরু-খাসির পদ রান্না হয়নি। রেস্তোরাঁ চালু রাখতে দু-এক পদের মুরগি পোলাও বিক্রি করা হচ্ছে। আর মাংস না থাকায় কোনো বাড়তি খাবার সরবরাহের অর্ডারও নেওয়া যাচ্ছে না। এখানেই শুধু নয়, আমাদের রাজধানীর সব শাখায়ও একই অবস্থা। এতে আমাদের লোকসান গুনতে হবে।’
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সব মাংসের দোকানই বন্ধ পাওয়া গেছে। এরপর রাজধানীর বেশ কয়েকটি সুপারশপ ঘুরেও মাংসের দেখা মেলেনি। এমনকি গতকাল সকালে ‘বেঙ্গল মিট’ নামের স্বতন্ত্র মাংস বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানেও মাংস ছিল না। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেঙ্গল মিটের আইটলেটগুলো মাংস বিক্রি করলেও খুব সকালেই তা শেষ হয়ে যায়। ফলে দুপুর নাগাদ রাজধানীর কোথাও মাংস পাওয়া যায়নি।
ধর্মঘটের আওতাভুক্ত না হলেও সুপারশপগুলোয় মাংস না থাকার কারণ জানতে চাইলে রামপুরার ‘স্বপ্ন’ সুপারশপের ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম জানান, আজ (গতকাল) সাপ্লায়াররা কোনো মাংস দেননি। ফলে বিক্রি বন্ধ রয়েছে।’
এদিকে যোগাযোগ করা হলে বেঙ্গল মিটের সহকারী মহাব্যবস্থাপক হাসান হাবিব বলেন, ‘আমরা মাংস বিক্রি করলেও অন্য কোথাও না থাকায় খুব সকালেই শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ এমন পরিস্থিতির কারণে বাড়তি জোগান দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। প্রচুর হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে ফোন আসছে। কিন্তু রেগুলার কাস্টমারদের বাইরে কাউকে দেওয়া হচ্ছে না।’
গতকাল পুরান ঢাকা ও নীলক্ষেত এলাকায় শত শত বিরিয়ানি-কাচ্চি-তেহারির দোকানে গরু-খাসির মাংস রান্না হয়নি। এছাড়া রাজধানীজুড়েই বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় কাবাব, টিকিয়া, চপের মতো খাবার বিক্রেতাদের দোকান বন্ধ ছিল। এর প্রভাব পড়েছে ফাস্টফুডের দোকানেও।
নীলক্ষেত এলাকায় রয়েল তেহারি ঘরের সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘ভালোবাসা দিবসের কারণে মঙ্গলবার দোকান খোলা হয়েছে। তবে এমন ধর্মঘট আর চার দিন চললে দোকান বন্ধ রাখতে হবে। কারণ এখানে গরু-খাসির মাংসের আইটেম ছাড়া কিছু চলে না।’
কারওয়ান বাজারের গরুর মাংসের দোকানি শহিদুল্লাহ বলেন, সমিতির নির্দেশনা অনুযায়ী দোকান বন্ধ রেখেছেন তিনি। খাসির মাংসের দোকানও এর আওতায় রয়েছে। শনিবারের আগে এ বাজারে কোনো মাংস বিক্রি করা যাবে না এটা সমিতির কঠিন নির্দেশ। এছাড়াও কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁয়ও মাংস সরবরাহ করা হবে না। তাহলে জরিমানা হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম জানান, রাজধানীতে প্রায় পাঁচ হাজার দোকানে ধর্মঘটের কারণে গরু, মহিষ ও ছাগলের মাংস বিক্রি বন্ধ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের সমস্যার সমাধান না হলে সারা দেশে ধর্মঘট ডাকতে বাধ্য হবেন ব্যবসায়ীরা।
ঢাকার একমাত্র গবাদিপশু কেনাবেচার স্থানীয় হাট গাবতলীতে ইজারাদারদের ‘উচ্চমাত্রায় ট্যাক্স’ আদায় বন্ধসহ কয়েকটি দাবিতে মাংস ব্যবসায়ীরা এ ধর্মঘটের ডাক দেন। ঢাকা মহানগর মাংস বিক্রেতা সমিতির অভিযোগ, আট মাস ধরে মাংস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নির্ধারিত খাজনার চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করছেন গাবতলী পশুর হাটের ইজারাদার। প্রতিটি গরুর জন্য বাড়তি দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
রবিউল আলম বলেন, ‘মাংসের বাড়তি দামের কারণে বেশিরভাগ দোকানে গরু জবাই কমে গেছে। ক্রেতাদের মাংসে অনাগ্রহ আসছে। এছাড়া ট্যানারিগুলোয় নামমাত্র দামে চামড়া কেনা হচ্ছে। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ী তাদের পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে আরও বিপদে ফেলছে। ফলে আমরা কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।’
ব্যবসায়ীদের আরও দাবির মধ্যে রয়েছে সীমান্তের ট্যাক্স কমানো, সেখান থেকে শহরের পশুর হাটে পশু আনার সময় পথে চাঁদাবাজি বন্ধ করা। এ দাবিগুলো পূরণ করলে মাংসের দাম কমানো সম্ভব বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
তবে ব্যবসায়ীদের দাবি যাই হোক, এ ধর্মঘটকে দাম বাড়ানোর কৌশল মনে করছেন অনেক ক্রেতা ও রেস্তোরাঁ মালিক। কারওয়ান বাজারে এনামুল হক নামের এক ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মাত্র এক বছর আগেও এক কেজি গরুর মাংস কেনা যেতো ৪০০ টাকায়। এখন তা ৫০০ টাকা ছুঁই-ছুঁই করছে। চাঁদাবাজি তো তখনও ছিল, এখনও আছে। এখন বিক্রি বন্ধ, এটি দাম বাড়ানোর কৌশল মাত্র। এ ধর্মঘটের ফলে মাংসের দাম বাড়বে, আর কিছুই হবে না।’