হোসাইন মুবারক: কয়েক দিন আগে রাজধানীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ে একটি কর্মশালা হয়ে গেল। নতুন ধরনের এ দূষণ নীরবে ঘটে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। এ দূষণ এত সূ² যে, এটা খালি চোখে দেখা যায় না। এ কারণে এ খবর সাধারণ মানুষের জানারও কথা নয়। তবে এ দূষণ নিয়ে বিষেশজ্ঞদের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিসংখ্যান।
রাজধানীতে প্রসাধন সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের কারণে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা মাইক্রোবিডসের দূষণ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার লক্ষ্যে কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা এ চিত্র তুলে ধরেন।
গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিন-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রতি মাসে প্রায় সাত হাজার ৯২৮ বিলিয়ন মাইক্রোবিডস বাংলাদেশের প্রধান তিন শহর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের নদী-নালা, খাল-বিল এবং অন্যান্য জলাশয়ে গিয়ে জমা হচ্ছে। মাইক্রোবিড হলো এক মিলিমিটারের চেয়েও ক্ষুদ্র গোলাকৃতির প্লাস্টিক কণা। প্রতি মাসে এ তিনটি শহর থেকে যথাক্রমে ৬৬২৮ দশমিক ৪৬, ১০৮৭ দশমিক ১৮ ও ২১২ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মাইক্রোবিডস মাইক্রোপ্লাস্টিক নদী, খাল বিল ও জলাশয়ে গিয়ে জমা হচ্ছে। ফলে হƒদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, লিভার, অন্ত্র, ত্বক, দাঁত প্রভৃতি ভয়াবহ রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। একই সঙ্গে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের দূষণের পেছনেও দায়ী মাইক্রোপ্লাস্টিক। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষণা যেহেতু ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ বিষয় তাই দেশের অন্যান্য জেলার চিত্র কী রকম, তা উঠে আসেনি। হয়তো ভব্যিষতে আসতেও পারে। তবে অনুমান করা যায়, যেসব উপাদানের কারণে তিন জেলায় এ দূষণ ঘটছে, তার ব্যাপক ব্যবহার দেশের সর্বত্রই আছে। এ কারণে বলা যেতে পারে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণের মাত্রা কমবেশি সব জেলায় কাছাকাছি একই রকম হবে। খুব একটা তারতম্য না হওয়ারই কথা।
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক সচিব ও এসডোর চেয়ারপারসন সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ, পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক জিয়াউল হক, সাবেক পরিচালক মাহমুদ হাসান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আবু জাফর মাহমুদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভ‚গোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. নূরুল ইসলাম নাজেমসহ বিশেষজ্ঞরা। তারা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন ধরনের এ দূষণ সম্পর্কে গণসচেতনতামূলক আলোচনা করেন।
কর্মশালায় বলা হয়, মাইক্রোপ্লাস্টিকের যেসব উপাদান পরিবেশদূষণ ঘটাচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে পলিথিলিইন (পিই), পলিমিথাইল মেথ্যাক্রিলেটে (পিএমএমএ), নাইলন, পলিইথিলিন টেরাফ্যাথালেট (পিইটি) এবং পলিপ্রোপাইলিন (পিপি)। এসব উপাদানে তৈরি ব্যবহার্য পণ্যের অবশেষ ভাঙতে ভাঙতে কণাগুলো এতই সূ² হয় যে, খালি চোখে তা দেখা যায় না; সুয়েজ ট্রিটমেন্টের মাধ্যমেও এটি নির্মূল করা সম্ভব হয় না। পানিপ্রবাহের সঙ্গে এসব মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা ডোবা, জলাশয় ও খাল-বিলে মিশে যায়; মিশে যায় নদী-নালার পলিতে, এরপর স্রোতের টানে শেষ গন্তব্য বিশাল সাগরের তলদেশে। মাছেরা এগুলোকে খাবার মনে করে খেয়ে ফেলে এবং ওইসব মাছ খেলে এর মাধ্যমে একসময় এটি মানবদেহে পৌঁছে যায়। আকারে অত্যন্ত ছোট হলেও এর পৃষ্ঠতল বড়, যেখানে এতে দূষিত পদার্থ জমা হয়। আর মাছেরা সহজে এগুলো খেয়ে ফেলে। তাই এটি খাদ্য হিসেবে মাছের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করলে লিভার, অন্ত্রসহ বিভিন্ন অঙ্গের প্রভ‚ত ক্ষতি করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক সহজে পচে না বা ক্ষয়ে নষ্ট হয় না; এটি আমাদের অদৃশ্যভাবে পরিবেশদূষণের আরেকটি অজানা অধ্যায়।
এসডোর মহাসচিব ইকোলজিস্ট বিশেষজ্ঞ ড. শাহরিয়ার হোসেনের গবেষণামতে, প্লাস্টিক দূষণ সচেতন বিশ্বে উদ্বেগের একটি বিশেষ কারণ। সামগ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্যরে এক বিশাল অংশীদার হলো নিত্য ব্যবহার্য পণ্য ও প্রসাধনীতে ব্যবহৃত মাইক্রোবিডস। ফেসওয়াশ, ফেশিয়াল স্ক্রাব, টুথপেস্টসহ বিবিধ পণ্যে মাইক্রোবিডস বা মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যাপক হারে ব্যবহার হচ্ছে। প্রসাধনসামগ্রী ও টুথপেস্টে ব্যবহৃত মাইক্রোবিডস ত্বক ও দাঁতের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ একেবারেই নতুন একটি বিষয় এবং নির্মাতা ও ভোক্তা কেউই মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং মাইক্রোবিডসের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন নয়। গবেষণামতে, জলজ প্রাণী মাইক্রোবিডকে তাদের খাদ্য মনে করে প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করছে, যেগুলো আবার মানুষের দেহে প্রবেশ করছে। এভাবে মাইক্রোবিড বিভিন্ন জলজ প্রাণী থেকে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে।
প্রতিদিন কী পরিমাণ প্লাস্টিক আবর্জনা আমাদের নদী, জলাশয় ও সমুদ্রে জমা হচ্ছে এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকুলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তা গবেষণা করে বের করা হয়েছে।
ইউরোপের দেশগুলোয় মাইক্রোপ্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ হয়েছে আরও আগে। তার পরও উন্নয়নশীল দেশে বিভিন্ন উৎপাদনে পণ্যের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোয় যেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা হলো সেখানে এর বিপরীতে বিকল্প হিসেবে তারা ওইসব পণ্যে কী ব্যবহার করছে। নিষিদ্ধে পর তারা তো এখন ওইসব পণ্য বাজারজাত করছে? গবেষণায় কিন্তু বিস্তারিত বলা হয়নি। এসব বিষয় গবেষণায় উঠে আসা জরুরি ছিল; তাহলে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবহারকারীরা সচেতনতামূলক দিকনির্দেশনা পেতেন। মাইক্রোপ্লাস্টিক অতি সূ²মাত্রার দূষণ। এসব চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও ধরা কঠিন। ক্ষতি অত্যন্ত গভীরে, যা লাখো মানুষের জীবননাশের কারণ হতে পারে।
সভ্যতার জয়যাত্রায় দৈনন্দিন জীবনে মানবসমাজ কত রকম দূষণের যে শিকার হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। ট্যানারির রাসায়নিক মিশ্রিত উচ্ছিষ্ট থেকে খামারের হাঁস-মুরগি ও চাষ করা মাছের খাবার তৈরির কথা অনেক আগেই শোনা গেছে; যে খাবার খাওয়া হাঁস-মুরগি বা মাছ মানুষ খেলে শরীরে সূ²মাত্রার দূষণের আশঙ্কা থাকে। মোটাতাজাকরণ ইনজেকশন নেওয়া মৃত গরু খেয়ে শকুনেরা বিলুপ্তপ্রায় এটাও একধরনের মারাত্মক দূষণ। অধিক শিল্পায়নের ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলোর কলকারখানার কার্বন ডাই-অক্সাইড আজ ঊর্ধ্বাকাশের ওজোন স্তর ক্রমে ক্ষয়ে দিচ্ছে। বিশ্ব ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। অতিবৃষ্টিতে বন্যা, অনাবৃষ্টিতে খরা এসব এখন নানা দূষণের ফল। এসব দূষণ মানুষকে নানাভাবে দুর্ভোগে ফেলছে। এত সব দূষণের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ মানুষের জীবনে ভয়ংকর নীরবযাত্রা শুরু করেছে, যা এত দিন মানুষের চিন্তাচেতনার বাইরে ছিল।
সরকারকে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিষিদ্ধের কথা ভেবে দেখতে হবে। সেই সঙ্গে আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে হবে, যেন ইউরোপের আদলে মাইক্রোবিডসযুক্ত পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা যায়। জনসাধারণকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবেÑযেন এসব পণ্য না কিনে বরং বর্জন করে। তাহলেই কেবল পরিবেশসহ মানুষ এ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে পারে।
গণমাধ্যমকর্মী
mubarokhosen83Ñgmail.com
Add Comment