জাকিয়া আহমেদ: বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। কারণ এখনও পর্যন্ত প্রায় ১১৬টি দেশে মাঙ্কিপক্সের (এম-পক্স) প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল দুদিন আগে জানিয়েছে, ২০২২ সালের শুরু থেকে গত জুলাই (২০২৪) মাসের শেষ পর্যন্ত সারাবিশ্বের ১১৬টি দেশে মাঙ্কিপক্সের ৯৯ হাজার ১৭৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং মারা গেছেন ২০৮ জন। অন্যদিকে ২০২৪ সালে আফ্রিকান সিডিসি জানিয়েছে, ১৪ হাজার ৭১৯ জন সন্দেহভাজন এবং ২ হাজার ৮২২ জনের দেহে এমপক্স শনাক্ত হয়েছে; এদের মধ্যে ৫১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মাঙ্কিপক্স নিয়ে বিস্তারিত তথ্য এখনও জানেন না অনেকেই। তাই এই রোগ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত প্রাণিবাহিত (জুনোটিক) রোগ। ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের একটি ল্যাবে বানরের দেহে সর্বপ্রথম এ রোগ শনাক্ত হয়; যার কারণে এর নামকরণ করা হয় মাঙ্কিপক্স।
তবে এই রোগের জন্য একমাত্র বানর দায়ী নয় বলে মনে করেন গবেষকরা। এ রোগটির প্রাদুর্ভাব ১৯৭০ সাল থেকে প্রধানত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার ১১টি দেশে দেখা যায়। ইতোপূর্বে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। তবে সেসব ক্ষেত্রে উক্ত দেশসমূহে ভ্রমণের ইতিহাস অথবা উক্ত দেশসমূহ হতে আমদানিকৃত প্রাণীর সংস্পর্শে আসার ইতিহাস ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার দেওয়া তথ্যমতে, এমপক্সে আক্রান্ত বানর থেকে ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ বর্গের পোষা প্রাণীর মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে। তবে সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী (যেমনÑগরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, মহিষ) থেকে এ রোগ ছড়ায় না। সম্প্রতি মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ানোর প্রবণতা দেখা গেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এমপক্স ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে। এই পক্সে সংক্রমিত ব্যক্তিকে স্পর্শ করা, চুমু দেয়া, যৌন সম্পর্ক থেকে এটি ছড়াতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসের খুব কাছাকাছি থাকলেও সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া এমপক্স আক্রান্ত বন্যপ্রাণী শিকার করা, চামড়া তোলা, মাংস কাটা, এমনকি রান্নার সময়, কম তাপে রান্না করা খাবার খেলে, সেখান থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। এমপক্স আক্রান্ত প্রাণীর কাছাকাছি গেলেও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এমপক্স সংক্রমিত রোগীর ব্যবহার করা পোশাক, তোয়ালে, বিছানার চাদর, যে কোনো ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। সংক্রমিত রোগীর ব্যবহার কর ইনজেকশনের সুই অন্য কারও শরীরে প্রবেশ করালেও এমপক্স হতে পারে। এছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারী এমপক্স আক্রান্ত হলে অনাগত সন্তানও এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। এমপক্স শুকিয়ে যাওয়ার পর ফোসকার আবরণ যদি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, সেখান থেকেও ভাইরাস সংক্রমণ
হতে পারে।
চিকিৎসকদের মতে, মাঙ্কিপক্স রোগের সাধারণ উপসর্গগুলো হচ্ছেÑজ্বর (৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ১০০ ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রা), প্রচণ্ড মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া ও ব্যথা (লিম্ফ্যাডিনোপ্যাথি), মাংসপেশিতে ব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা, সাধারণত জ্বরের ৩ দিনের মধ্যে ফুসকুড়ি হওয়াÑযা মুখ থেকে শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে হাতের তালু, পায়ের তালুসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। উপসর্গগুলো সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
মাঙ্কিপক্স রোগীর দেহে লক্ষণ দেখা না দিলে রোগী থেকে অন্য কারও মধ্যে ভাইরাসটি ছড়ায় না। শরীরে ফুসকুড়ি (ভেসিকল, পাস্তিউল) দেখা দেয়া থেকে শুরু করে ফুসকুড়ির খোসা (ক্রাস্ট) পড়ে যাওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে রোগ ছড়াতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলো আপনা-
আপনি সেরে যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, নবজাতক শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি (যেমনÑঅনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কিডনি রোগী, ক্যান্সারের রোগী, এইডসের রোগী) এই রোগের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকেন।
আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অথবা আক্রান্ত দেশ থেকে ফিরে আসার ২১ দিনের মধ্যে জ্বর এলে এবং ফুসকুড়ি দেখা দিলেÑএমপক্স ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে অতিদ্রুত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইন ১০৬৫৫ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলো আপনা-আপনি উপশম হয়ে যায় বলে নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না। তবে উপসর্গ নিরাময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। যেমনÑজ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, ফুসকুড়ি শুকনো রাখা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পরিমিত বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি ও তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ ইত্যাদি। এছাড়া শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন জানান, ‘মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সেবাপ্রদানকারী উভয়কেই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহƒত দ্রব্যাদি সাবান/জীবাণুনাশক/ ডিটারজেন্ট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। আক্রান্ত জীবিত কিংবা মৃত বন্যপ্রাণী থেকে দূরে থাকতে হবে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যায়। তবে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের (যেমনÑঅনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কিডনি-ক্যানসার-এইডস আক্রান্ত রোগী) নবজাতক শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী) ক্ষেত্রে এটি শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শারীরিক জটিলতাগুলোর মধ্যে রয়েছেÑত্বকে সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, মানসিক বিভ্রান্তি, চোখে প্রদাহ এবং দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে পারে। ‘এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই, সরাসরি ওষুধ নেই। রোগীকে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। এমপক্স নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কারণ নির্ভর করবেÑআমাদের আশপাশের দেশগুলোয় সংক্রমণ কেমন তার ওপর। এজন্য আমাদের এখন থেকেই দেশের প্রবেশপথগুলোয় স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে। লক্ষণ দেখা দেয়া ব্যক্তিদের পরীক্ষা করাতে হবে।
এমপক্স আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের বিশেষ নজর দিতে হবে। এমপক্সের সংক্রমণ করোনা মহামারির মতো হবে না বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি বলছে, বিশ্বজুড়ে এমপক্স হিসেবে পরিচিত মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ আরেকটি করোনা মহামারির মতো হবে না। এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, এই ভাইরাস অজানা নয়, এটি সম্পর্কে সবকিছুই মোটামুটি জানা। এর অর্থ হলো ভাইরাসটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে করোনার মতো করে এমপক্স ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে তা সত্ত্বেও সতকর্তা নিতে হবে, সজাগ থাকতে হবে সংশ্লিষ্টদের। ‘ভারতে এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি নয়। পশ্চিমবঙ্গেও কাউকে পাওয়া যায়নি। এসব আমাদের জন্য ভালো খবর।
তবে কঠোর পর্যবেক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ, যেসব দেশে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ বেশি, সেসব দেশের সঙ্গে কিন্তু আমাদের যোগাযোগ আছে। তাই সতর্কতার বিকল্প নেই।’ বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্স রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে গত ১৭ আগস্ট। এ কথা জানান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী
পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এয়ারলাইনসগুলোকে সতর্ক থাকতে এবং কোনো লক্ষণযুক্ত যাত্রী থাকলে দ্রুত স্বাস্থ্য বিভাগকে জানাতে বলা হয়েছে। আগমনের ২১ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দিলে যাত্রীদের ১০৬৫৫ নম্বরে কল করতে বলা হয়েছে।’ এইচএসআইএ স্বাস্থ্য বিভাগ এরই মধ্যে লক্ষণযুক্ত যাত্রীদের মোকাবিলার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। লিফলেট দেয়ার পাশাপাশি আগমন স্বাস্থ্য ডেস্কগুলোয় ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার রাখা হয়েছে। এইচএসআইএ আগত যাত্রীদের তাপমাত্রা থার্মাল স্ক্যানার আর্চওয়ে দিয়ে স্ক্রিন করছে। প্রয়োজন হলে লক্ষণযুক্ত যাত্রীদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক রোগ হাসপাতাল (আইডিএইচ) ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে পাঠানো হবে। একইদিনে সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে চালু করা হয়েছে মেডিকেল স্ক্রিনিং ব্যবস্থা, প্রস্তুত করা হয়েছে আইসোলেশন কক্ষ।
এ ছাড়া সব যাত্রীর তাপমাত্রা থার্মাল স্ক্যানারের দ্বারা স্ক্রিন করা হয় এবং প্রয়োজন হলে লক্ষণযুক্ত যাত্রীদের সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে পাঠানো হবে।
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সেখানে তিন সদস্যের মেডিকেল টিম গঠন করে আক্রান্তদের শনাক্তে চালু করা হয়েছে থার্মাল স্ক্যানার। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগও এমপক্স ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে এমপক্স রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য সহকারী ও সেবা সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে এখনও এই রোগের কোনো রোগী ধরা পড়েনি। দেশের মানুষকে যে কোনো ধরনের গুজবে বা আতঙ্ক এড়িয়ে চলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতে এই রোগ থেকে সবাইকে আতঙ্কিত না হয়ে, সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।