মুহাম্মদ ফয়সুল আলম: ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর মুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মসূচি। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ১৯৭২ সালের জুলাইয়ে কুমিল্লার এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন মাছ হবে দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা গণভবনের লেকে পোনা মাছ অবমুক্ত করে মৎস্য উৎপাদনে সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতিরÑ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে, আর এখানেই শুরু হয় মাছের আঁতুড়ঘরের অপমৃত্যু। কিন্তু বীর জাতি বাঙালি রক্তের দাগ শুকানোর আগেই মাছ চাষে মনোযোগী হয়ে ওঠে।
কথায় আছে‘মাছে-ভাতে বাঙালি।’ এটি শুধু প্রবাদ নয়, বাঙালির জাতীয় চেতনাও বটে। এ চেতনাকে ধারণ করেই মাছচাষি, মৎস্যবিজ্ঞানী ও গবেষক এবং সম্প্রসারণবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও ২৩ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই দেশব্যাপী ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ, ২০২২’ পালিত হচ্ছে। এবারের মৎস্য সপ্তাহ দিবসের সেøাগান হচ্ছে‘নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’ নিরাপদ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেশের মানুষকে আরও সচেতন ও সম্পৃক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে এবারের মৎস্য সপ্তাহ উদ্যাপন করা হচ্ছে। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচি এবং দেশের সব জেলা-উপজেলায় স্থানীয় কর্মসূচি পালন করা হবে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটানো, অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সরকারের সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ, কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি আয়ের ১ দশমিক ২৪ শতাংশ মৎস্য খাতের অবদান। মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। উš§ুক্ত জলাশয়ে মাছচাষ, বিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতির সংরক্ষণ, মাছের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম সৃষ্টি, জাটকা সংরক্ষণ, মা ইলিশ সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব চিংড়িচাষ প্রভৃতি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার চীন থেকে বিশুদ্ধ জিনপুল-সমৃদ্ধ ৩৮ হাজার ৪৬১টি চাইনিজ কার্প, যেমনÑসিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ও বিগহেড কার্প আমদানি করেছে। বর্তমানে দেশের ৩৯টি সরকারি খামারে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে রেণু উৎপাদন করে এ মূল জাত পর্যায়ক্রমে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি খামারে এবং চাষি পর্যায়ে সরবরাহ করা হচ্ছে।
মাছের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া মাছের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার ‘দক্ষিণ বিশিউড়া’ ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ‘হালইসার’ গ্রামকে ‘ফিশার ভিলেজ’ বা ‘মৎস্য গ্রাম’ ঘোষণা করেছে। গ্রামীণ মৎস্যচাষি ও জেলেদের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে দেশব্যাপী জেলে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান এবং ডেটাবেজ তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশি ছোট মাছের উৎপাদন প্রায় সাড়ে চারগুণ বেড়েছে। ২০০৯ সালে পুকুরে চাষের মাধ্যমে দেশি ছোট মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার ৩৪০ টন, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় তিন লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। আমাদের দেশে মৎস্য উৎপাদনে দেশি ছোট মাছের অবদান ৩০-৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে মলা, ঢেলা, পুঁটি, বাইম, টেংরা, খলিশা, পাবদা, শিং, মাগুর, কাচকি, চান্দা প্রভৃতি অন্যতম। এসব মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে এবং রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
২০২০-২১ অর্থবছরে মাছ উৎপাদিত হয়েছে ৪৬ লাখ ২১ হাজার লাখ টন, যা ২০১০-১১ অর্থবছরের মোট উৎপাদনের (৩০ লাখ ৬২ হাজার টন) তুলনায় ৫০ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি। তাছাড়া ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন ছিল সাত লাখ ৫৪ হাজার টন। গত ৩৮ বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ছয়গুণের অধিক। মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় জাটকা রক্ষায় ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পরিবারপ্রতি মাসিক ৪০ কেজি এবং ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিনের জন্য পরিবারপ্রতি ২০ কেজি হারে চাল প্রদান করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে জাটকা ও মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৪৪টি জেলে পরিবারকে মোট ৭০ হাজার ২৬০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
মৎস্য খাতের উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার নিমিত্তে সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু নীতি, আইন বিধিমালা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের দূরদর্শিতার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারিত হওয়ায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মৎস্য আহরণে আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি এবং স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সরবরাহ ও মান নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত সব তথ্যাদি সংরক্ষণের জন্য অ্যাকোয়া ফুড সেফটি আর্কাইভ মৎস্য ভবনে স্থাপন করা হয়েছে।
খাদ্যনিরাপত্তা সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা। কেবল খাদ্যের প্রাপ্যতা নয়, সুষম খাদ্য নিশ্চিত করাই সরকারের লক্ষ্য। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে রূপান্তর করতে নিরাপদ খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, জনগোষ্ঠীর পুষ্টিচাহিদা পূরণ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। মৎস্য উৎপাদনের অর্জিত সাফল্যকে স্থায়িত্বশীল করে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
পিআইডি নিবন্ধ