মাছ চাষে প্রযুক্তির ব্যবহার

সেলিনা আক্তার: কথায় আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। এটি শুধু প্রবাদ নয়, বাঙালির জাতীয় চেতনাও বটে। এ চেতনাকে ধারণ করেই মাছচাষি, মৎস্যবিজ্ঞানী ও গবেষক এবং সম্প্রসারণবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ মৎস্য সম্পদে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে।
সম্প্র্রতি প্রযুক্তিগত গবেষণার ফলে মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য দেখা দিয়েছে। যে কারণে সবার জন্য ভবিষ্যতে চাষের মাছ সহজলভ্য হবেÑ এ কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে। সাম্প্র্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, মাছ চাষে দেড় দশকে ১৫০ শতাংশেরও বেশি উৎপাদন বেড়েছে। অ্যাকুয়াকালচার বা চাষের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে পঞ্চম। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ভবিষ্যতে সুলভে চাষের মাছ মিলবে। মূলত দেশি মাছের চাষোপযোগী উন্নত জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পুরো কৃতিত্ব দেশের বিজ্ঞানীদের। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) একাধিক প্রতিবেদনেও দেশে পুকুরে মাছ চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের তথ্যটি ওঠে এসেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২’ বৈশ্বিক প্রতিবেদন মতে স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে তৃতীয়। শুধু তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশ প্রতি বছর সমুদ্র থেকে ৬ লাখ ৭০ হাজার টন মাছ সংগ্রহ করা ছাড়াও পুকুর ও হাওর-বাঁওড়ে মৎস্য উৎপাদন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মাছের সাইজ, ওজন, রং ও স্বাদ সবকিছুই বেড়েছে। দেশে মৎস্যচাষে এ সফলতার পেছনে আছে মৎস্য বিভাগের বহুমুখী গবেষণা, আধুনিক পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির সহায়তা। এসব প্রযুক্তির মধ্যে অন্যতম হলো রাস, আইপিআরএস এবং বায়োফ্লক পদ্ধতি।

রাস পদ্ধতি: মাছচাষে যান্ত্রিকীকরণের জন্য আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় প্রযুক্তিতে বিদ্যমান সম্পদ ব্যবহার করে কম খরচে আধুনিক পদ্ধতির নাম রিসারকুলেটিং অ্যাকোয়াকালচার সিস্টেম (রাস)। এ পদ্ধতিতে বিদ্যমান মাছ চাষের চেয়ে ৮০ থেকে ১০০ গুণ বেশি মাছ উৎপাদন সম্ভব। তাছাড়া দেশীয় সম্পদ ও কারিগরি দক্ষতা ব্যবহার করে অত্যন্ত কম মূল্যে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। রাস পদ্ধতিতে যে কোনো বদ্ধ জলাশয়ে নিবিড়ভাবে এক শতকে মাছ চাষ করলে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ কেজির মতো মাছ পাওয়া যায়। এভাবে প্রতি ঘনমিটার জায়গায় ১ হাজার লিটার পানিতে ‘রাস’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ৮০ থেকে ৯০ কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব। এ পদ্ধতিতে ব্যবহƒত প্রতিটি ট্যাংক সাড়ে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার লিটার পানি ধারণ করতে পারে। সে হিসাবে একটি ১০ হাজার লিটার ট্যাংকে কমবেশি ৮০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়। ‘রাস’ পদ্ধতিতে মাছের মল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্যাংক থেকে ফিল্টারিং করে একেবারে তলানিতে নিয়ে আসা হয়। এজন্য এ পদ্ধতিকে রেসওয়ে বটমক্লিন পদ্ধতি বলা হয়। পরবর্তী সময়ে এ মল বের করে অ্যাকোয়াফনিক্সসহ বিভিন্ন কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায়।

বায়োফ্লক পদ্ধতি: দেশীয় আবহাওয়ার উপযোগী করে পুকুর না কেটে স্বল্প খরচে অধিক মাছ চাষের নতুন এক প্রযুক্তির নাম ‘বায়োফ্লক’। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি যা ক্রমাগতভাবে পানিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলোকে পুনরাবর্তনের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করে। সাধারণত মাছের জন্য পুকুরে যে খাবার দেয়া হয়, তার উচ্ছিষ্ট পুকুরে দূষিত অ্যামোনিয়া তৈরি করে, যা মাছের জন্য ক্ষতিকর। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়া থেকেও প্রোটিন তৈরি করে মাছের খাদ্য হিসেবে পুনর্ব্যবহার করা যায়। এতে মাছের খাবার খরচ কমে যায়। এ প্রযুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো মাছের মজুত ঘনত্ব দ্রুত বাড়ে। এ প্রযুক্তি পানিতে বিদ্যমান কার্বন ও নাইট্রোজেনের সাম্যবস্থা নিশ্চিত করে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করে। এ পদ্ধতিতে বাড়ির আঙিনায়, ছাদে, অল্প জায়গায় এমনকি সবজি ও মাছ একসঙ্গে চাষ করা যায়। মাছ চাষের জন্য ট্যাংক, অক্সিজেন সরবারাহের পাম্প ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। প্রথমে ট্যাংকে পানি দিয়ে এক সপ্তাহ অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। এতে আয়রন বা অন্য ভারী পদার্থ থাকলে ওপরে জমা হয়। এ পদ্ধতিতে অল্প জায়গায় বেশি পরিমাণ মাছ চাষ করা যায়। তাই অধিক লাভজনক। বাড়িতে যে কেউ সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে ১০ থেকে ১২টি ট্যাংকে সহজেই মাছ চাষ করতে পারে।
আইপিআরএস-ইন-পন্ড রেসওয়ে সিস্টেম (আইপিআরএস) : যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত মাছ চাষের সর্বাধুনিক একটি প্রযুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামা রাজ্যে অবস্থিত অ’বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫ সালে প্রথম উদ্ভাবন করা হয়। তবে ২০১৩-১৪ সালের দিকে চীনে এ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত এবং পাকিস্তানেও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছচাষ শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশেও এর ব্যবহার অনেক। এটি হলো মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর, খাঁচা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং অক্সিজেন-খাদ্যের সুষম বণ্টনের একটি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা।

এর মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ ও কৌশল ব্যবহার করে স্বল্প জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণে মাছ চাষ করা হয়। এ প্রযুক্তিতে বড়ো আকারের পুকুরে কংক্রিটের ছোটো ছোট চ্যানেল তৈরি করা হয়। সেখানে কৃত্রিম স্রোত তৈরি করে অনেকটা নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয়ের মতো পরিবেশ তৈরি হয়। এ ধরনের প্রকল্পে পুকুরের মাঝে রেসওয়ে বা কংক্রিটের ছোটো ছোটো সেল তৈরি করা হয় এবং সেলের মধ্যে থাকা মাছগুলো স্রোতে ক্রমাগত নদীর মতো সাঁতার কাটতে থাকে। এ কারণে আইপিআরএস পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছের স্বাদ ও রঙ একেবারে নদীর মাছের মতোই হয়।

মাছ চাষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। তাহলে মাছ চাষের পাশাপাশি এর সংরক্ষণযোগ্যতাও নিশ্চিত হবে। চাষের আগে চাষযোগ্য স্থানের পানির মান, জৈবিক, রাসায়নিক এবং জীবতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য যাচাই করা প্রয়োজন। এজন্য প্রজননের সময়টায় সঠিকভাবে লালন-পালন করতে হবে। এছাড়া মাছের পোনা সময়মতো অবমুক্ত করা হলে অনেক কম জায়গায় বেশি মাছ পাওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে উন্নত প্রজাতির মাছও মিলবে এবং কম খরচে মাছ উৎপাদন করা যাবে। এজন্য মাছের পোনার সরবরাহ স্বাভাবিক থাকতে হবে। বর্তমানে পাঙাশ, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, রুই, সিলভার কার্প, মৃগেল, কাতলা, শিং, মাগুর চাষে অভূতপূর্ব ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এদিকে স্থলভাগের মোট কৃষিজ আয়ের শতকরা ২৪ ভাগের বেশি অবদান মৎস্য খাতে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এ হার আরও বেড়েই চলেছে, যুক্ত হচ্ছে শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীও।
বিবিএসের সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ মৎস্য কাজে নিয়োজিত এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বছরে গড়ে ৩৫ লাখ ৪৮ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চাষ করা মাছের পরিমাণই প্রায় ২০ লাখ টন। ইলিশের উৎপাদন প্রায় চার লাখ টন। চিংড়ি এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য। মুক্ত জলাশয়ে প্রাকৃতিক এবং ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাখ লাখ পুকুরে মাছ চাষে দেশে রুপালি বিপ্লব ঘটে চলেছে।

সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে নিত্যনতুন প্রযুক্তির সঙ্গে দেশের মৎস্যচাষিদের সম্পৃক্ত করতে হবে, ব্যবস্থা করতে হবে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও হাতেকলমে দক্ষতা অর্জনের। খামারগুলোয় সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও তদানুযায়ী কারিগরি সহায়তার ব্যবস্থা করা, উৎপাদিত মাছ দ্রুত পরিবহণে এবং বাজারজাতকরণে সহায়তা করা, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে খামারিদের তথ্যের আদান-প্রদানে সহায়তা করা, সহজ শর্তে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি (বেকারত্ব মোচন) করা যেতে পারে।

মাছ চাষের ফলে চাষিরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি বাজারে মাছ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। বাজারে সরবরাহ প্রচুর থাকলে মাছের দামও সহনীয় হবে, বিক্রি বেশি হলে মাছ পচে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমবে। এছাড়া দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমানে মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। মোট কথা, মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। এজন্য মাছচাষে সফলতা ধরে রাখতে হবে। তাতে মাছ চাষি, ব্যবসায়ী, ভোক্তা সব পক্ষই লাভবান হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০