সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার গর্ব

‘মাতৃভূমির সেবা করতে গিয়ে আমি করোনা পজেটিভ’

রহমত রহমান: করোনা মহামারির মধ্যে এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়নি কাস্টমস হাউস। আমদানি-রপ্তানি সচল রাখতে খোলা। সীমিত পরিসরে খোলা ছিল ভ্যাট কমিশনারেট। রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা আর প্রগাঢ় দেশপ্রেম থেকেই কর্মকর্তারা ঝুঁকি নিয়েই ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছেন। নেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী। তবুও দায়িত্ব পালনে নেই অনীহা, নেই ক্লান্তি।

## সুস্থ হয়ে প্লাজমা ডোনেট করবে এ কর্মকর্তা

## বন্ধু, ব্যাচমেট, কলিগ, কর্তৃপক্ষ, অ্যাসোসিয়েশন খোঁজ রেখে চাঙ্গা রাখছেন

এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইতোমধ্যে ২৫ জন কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। যার মধ্যে একজন ডেপুটি কমিশনার। অসংখ্য কর্মকর্তা অসুস্থ। সংস্পর্শে এসে অনেকেই আছেন ‘আইসোলেশনে’। আক্রান্ত অনেকেই চিকিৎসাধীন। আক্রান্তদের মধ্যে একজন ফয়সাল বিন আসিক। এ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ঢাকা কাস্টম হাউসে কর্মরত।

১১ দিন আগে এ কর্মকর্তার করোনা সনাক্ত হয়। বাসায় থেকে নিচ্ছেন চিকিৎসা। ঈদ কেটেছে একা একা। বাসায় থাকলেও দূরত্ব বজায় রেখেছেন। সাময়িক কষ্ট হলেও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন আর মাতৃভূমির সেবা করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হওয়ায় এ কর্মকর্তা গর্ববোধ করেন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে তুলে ধরেছেন করোনা আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা।

আরো পড়ুন-নতুন করে তিন কর্মকর্তা আক্রান্ত, মোট আক্রান্ত ২৫

আরো পড়ুন-প্রথমবার ভ্যাটের এক ডেপুটি কমিশনার করোনা আক্রান্ত

তা হুবহু তুলে ধরা হলো-‘আমি গর্বিত যে, এই ক্রান্তিকালে মাতৃভূমির সেবা করতে গিয়ে আমি ‘করোনা পজিটিভ’ হয়েছি। *আজ করোনা সনাক্ত হবার ১০ম দিন। *শুরু থেকে নিজেকে সবার থেকে আলাদা রেখেছি। *আমার সান্নিধ্যে আসা সবাইকে নিজ উদ্যোগে সতর্ক করেছি। *ঈদ কাটালাম একা একা ঢাকাতেই।’

আরো বলেন, ‘যেদিন আমার নমুনা সংগ্রহ করা হয় সেদিন এবং তার আগেরদিনও আমি ডিউটি করেছি। করোনাকালীন লকডাউন জুড়েই আমি ও আমরা কখনো রেগুলার ও কখনো শিফট ভিত্তিতে ডিউটি করেছি। আমার সঙ্গে ডিউটি করা রাজস্ব কর্মকর্তা আব্দুর রহমান মৃধা স্যারও করোনা আক্রান্ত। হয়তো একই দিনে একই বাহকের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি।’

বলেন, ‘বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতসহ গুরুত্বপূর্ণ বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের কাঁচামালের স্যাম্পল শুল্কায়নের দায়িত্ব থাকে আমাদের। এই কাজ বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। তাই জরুরী অবস্থার অধীনে শিফট ডিউটির মাধ্যমে পুরোদমে কাজ চলেছে। গড়ে ৭০০-৮০০ পেপার সমাধান করতে হয় আমাদের সেকশনে। এই কাজটি যেমন গুরুত্ব যেমন অনেক, তেমনি এই কাজে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাও অনেক কঠিন। নিজেদের এই ঝুঁকিকে মেনে নিয়েই কাজ করতে আমরা স্বতঃস্ফুর্ত। কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অন্যান্য জরুরী সেবার মতোই বুক চিতিয়ে সেবা দিয়ে যাবে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণার্থে।’

আশিক তুলে ধরেন, ‘মানসিকভাবে শক্ত থাকাই এই রোগ থেকে সেরে ওঠার আসল ঔষধ। আমার কোনো প্রকার লক্ষণ ছাড়াই করোনা পজিটিভ আসে। আর সনাক্ত হবার পরেও বেশ কিছুদিন কোনো উপসর্গ ছিল না। ৫ম দিন থেকে গলা ব্যথা, হালকা কাশি দেখা দেয়। ড. মোহসিন স্যার এর তত্ত্বাবধান ও পরামর্শে গরম পানির ভাপ, সহনীয় গরম জলে গড়গড়া করা, প্রেসক্রাইবড ঔষধ সেবন, পর্যাপ্ত পরিমানে ভিটামিন সি এবং ডি গ্রহণ ইত্যাদির মাধ্যমে দিনগুলোকে অতিবাহিত করে চলেছি। শীঘ্রই হয়তো পুনরায় স্যাম্পল দেব নেগেটিভ হলো কিনা তা জানতে।’

আরো বলেন, ‘পাবনা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডাক্তার Zakaria Manik ভাই পরামর্শ দিয়েছেন Arsenic Album 30 (হোমিও) ঔষধটি সেবন করার। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত সেরে ওঠেন। পুলিশ হাসপাতাল ইতোমধ্যেই হোমিও মেডিক্যাল ইউনিট খুলেছে আর পুলিশ হেডকোয়ার্টারও এ ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করেছে। তাই আমিও এই ঔষধ ডাক্তারি পরামর্শ মোতাবেক সেবন করেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কল করে একজন চিকিৎসক পরামর্শ প্রদান করেছেন এবং বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন।’

সবার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যারা রোগটাকে একটুও পাত্তা না দিয়ে ‘স্বাস্থ্যবিধি না মেনে’ ঘুড়ে বেড়ান, কিংবা উপসর্গ থাকার পরেও টেষ্ট করাচ্ছেন না তাদের বলব রোগটা মোটেও এতটা সহজ নয়। সপরিবারে আক্রান্ত হয়ে সবাইকে মারার জন্য এই রোগটা ভাল কার্যকরী হতে পারে, তাই সাবধান করছি। খুব জরুরী কাজ ছাড়া ঘরের বাইরেই যাওয়া যাবে না। আর যেতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানুন। লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই নিজেকে আলাদা করে ফেলুন। তথ্যসেবা নিন ও প্রয়োজন হলে টেস্ট করানোর মানসিকতা রাখুন। মনে রাখুন যে, আক্রান্ত হয়ে টেস্ট না করানোর মানসিকতা ভয়ানক হতে পারে।’

বলেন, ‘আর যারা সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন, আগে থেকেই পর্যাপ্ত ভিটামিন সি গ্রহণ করছেন, বাসায় ব্যায়াম করছেন, সতর্কতা হিসেবে গরম পানির ভাপ নিচ্ছেন, গড়গড়া করছেন, তাদের বলব, এই ভাল অভ্যাসগুলো চালিয়ে যান এবং খুব বেশি চিন্তিত হবেন না। আক্রান্ত হলেও আতঙ্কিত হবেন না।’

বলেন, ‘এই করোনায় যত লোক মারা যান, তার চেয়ে বেশি নাকি অতিরিক্ত চাপ নিয়ে স্ট্রোক বা হার্ট ফেইলর হয়ে মারা যান। তাই অতিরিক্ত টেনশন করবেন না। টেনশন করলে এই রোগে কি দশা হয়, তার ফল কি তাও কাছ থেকে দেখেছি আর মনোবল রেখে স্বাভাবিকভাবে নিলে কেমন ভাল থাকা যায় তাও নিজেই প্রত্যক্ষ করছি।’

বলেন, ‘রোগী একা একা মানসিক চাপমুক্ত থাকবে কিভাবে? সমাজ এখানে খুব বড় প্রতিপক্ষ! আচ্ছা, করোনা বড় রোগ? নাকি সমাজ বড় রোগ? যে সমাজের ভয়ে মানুষ করোনকে লুকাতে চায় সেই সমাজই বেশি ভয়ানক নয় কি? আক্রান্ত রোগী আলাদা থাকলে সে ভয়ানক নয়, বরং তাকে ও তার পরিবারকে মানসিকভাবে চাপে রাখলে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাকে এক স্থান থেকে তাড়িয়ে অন্যত্র পাঠানোর চেষ্টা আরো ভয়াবহ। এতে রোগটা ঐ কমিউনিটি, ঐ মহল্লায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘নাম ধরে বলতে গেলে অনেকের নাম বাদ পড়ে যাবে তাই সে পথে যাচ্ছি না। আমার বন্ধু, ব্যাচমেট, কলিগ, কর্তৃপক্ষ, অ্যাসোসিয়েশনের সবাই নিয়মিত খোঁজ খবর রেখেছেন, মানসিকভাবে চাঙ্গা রেখেছেন। ঈদের দিনে ঔষধ এনে দেয়া থেকে শুরু করে বাজার করে দেবার কাজও করেছেন। আত্মীয়- স্বজন সীমিত পরিসরে যারা জানতেন তারা নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমার বাড়িওয়ালা চমৎকার একজন মানুষ, ভাল মানুষ। তিনি ও তার পরিবার আমার আইসোলেশন নিশ্চিত করতে মানসিক সাপোর্ট দেবার পাশাপাশি ঔষধপত্র ও কাঁচাবাজার এনে দিয়েও সহায়তা করেছেন। এমন মানসিকতা সত্যিই প্রশংসনীয়। মানবতা একেবারেই উঠে যায় নি।’

সহকর্মীদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘যারা আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা একটি Oxymeter কিনে সাথে রাখতে পারেন। কখন অক্সিজেন সাপোর্ট লাগবে তা জানিয়ে এটি আপনার অনেক বড় উপকার করবে। আপনাকে চিন্তামুক্ত করতে অনেক সাহায্য করবে।’

বলেন, ‘আমার মেয়েকে ধন্যবাদ। এক বছর হতে চলেছে বয়স। ওকে আবার কোলে নেবার অদম্য ইচ্ছা আমাকে মানসিকভাবে শক্ত রেখেছে। ধন্যবাদ তাকে যে আড়ালে কাঁদলেও, হেসে হেসে কথা বলে আমাকে শক্তি জোগায়। সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ সেই মানুষকে যিনি আমার সীমাহীন সীমাবদ্ধতা। ঘাবড়াবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে ও নিজের পরিবারকেও বাঁচান, দেশকেও বাঁচান।’

বলেন, ‘এ পর্যন্ত কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাটের ২৫ জনের আক্রান্ত হবার খবর জানা গেছে। ইতোমধ্যেই কেউ কেউ তার পরিবারের সদস্য হারিয়েছেন করোনায়। সবাই সুস্থ হয়ে উঠুন আর স্বজন হারানো সবাইকে আল্লাহ শোক সামলে ওঠার শক্তি দিন। আল্লাহ তায়ালা সুস্থ করলে, ইনশাল্লাহ প্লাজমা ডোনেটের মাধ্যমে অপর আক্রান্তদের দ্রুত সুস্থ রাখায় অবদান রাখব।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০