মো. জিল্লুর রহমান: আমরা জানি শুধু মাথাপিছু আয় নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে, যদিও নভেল করোনাভাইরাস সব হিসাবনিকাশ উল্টোপাল্টা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
মাথাপিছু আয় বলতে সাধারণত কোনো দেশের মোট আয়কে জনপ্রতি ভাগ করে দিলে যা হয়, তাকে বোঝায়। জনগণের সর্বমোট ব্যক্তিগত আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। সাধারণত মাথাপিছু আয়কে প্রতিবছর টাকার এককে প্রকাশ করা হয়।
আর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের অভ্যন্তরে বা ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে বসবাসকারী সব জনগণ কর্তৃক উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের অর্থমূল্যের সমষ্টি। এতে ওই সীমানার মধ্যে বসবাসকারী দেশের সব নাগরিক ও বিদেশি ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের মূল্য অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে বিদেশে অবস্থানকারী ও কর্মরত দেশের নাগরিক/সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের আয় অন্তর্ভুক্ত হবে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, বিদায়ী অর্থবছর (২০১৯-২০) শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৪ ডলার। এর আগের অর্থবছরে মাথাপিছু গড় আয় ছিল এক হাজার ৯০৯ ডলার। অর্থাৎ দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় এক বছরের ব্যবধানে ১৫৫ ডলার বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় মানুষের মাথাপিছু আয় বছরে দাঁড়াচ্ছে গড়ে এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ মাসে গড় আয় প্রায় ১৪ হাজার ৬০০ টাকার মতো।
সঠিক জাতীয় আয়ের হিসাবটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। অনেক রকম বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। যেমন দ্বৈত গণনা সমস্যা। জাতীয় আয় গণনার ক্ষেত্রে অনেক সময় একটি দ্রব্য দুবার গণনা করা হতে পারে। যেমন বই ও কাগজের ক্ষেত্রে যদি বই ও কাগজের মূল্য উভয়ই জাতীয় আয়ের মধ্যে গণনা করা হয়, তাহলে জাতীয় আয়ের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। কারণ বইয়ের মূল্যের মধ্যে কাগজের মূল্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একবার কাগজের মূল্য এবং সেইসঙ্গে বইয়ের মূল্য পৃথকভাবে হিসাব করা হলে প্রকৃতপক্ষে কাগজের মূল্য দুবার গণনা করা হয়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। কিন্তু সমাজে বিশেষ করে নিন্ম-আয়ের মানুষের কতটা অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে, তা বাস্তবে দেখলেই অনুমান করা যায়।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৯৭২ সালে ছিল প্রায় ১২৯ ডলার, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৪ অর্থাৎ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় অন্তত ১৬ গুণ বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি। ওই সময়ে হতদরিদ্র মানুষের হার কমে শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
মাথাপিছু আয় বেশি হওয়া মানেই যে কোনো দেশের মানুষ খুব ভালো আছে, তা নয়। আমাদের অনেকের ধারণা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মানেই দেশ অনেক উন্নত হয়েছে, কিংবা মানুষের জীবনমানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেশি মানেই যে একটি দেশ খুব ভালো আছে, তা কিন্তু নয়। ধরা যাক, একজনের আয় ৯ হাজার টাকা এবং আরেকজনের আয় এক হাজার টাকা। এর অর্থ দুজনের মাথাপিছু গড় আয় পাঁচ হাজার টাকা। তার মানে তো এই নয় যে, দুজনেরই আয় সমান। সুতরাং এখানেই আয়বৈষম্যের বিষয়টি চলে আসে। সুতরাং মনে রাখতে হবে জাতীয় আয় বৃদ্ধিই উন্নয়ন নয়, উন্নয়ন আরও অনেক বড় বিষয়।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও সুষমভাবে সম্পদ বণ্টিত হচ্ছে কি না, সেটা মানুষের জীবনমান উন্নয়নের মৌলিক ভিত্তি। কারণ ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলথ এক্স ইনস্টিটিটিউট নামের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালে তাদের প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে ধনী তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ১০টি দেশের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ। তাদের মতে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অতি ধনী বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক তিন শতাংশ হারে। এখানে অতি ধনী বলতে তাদের বোঝানো হয়েছে, যাদের মোট সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৫০ কোটি টাকা। নানা পরিসংখ্যানে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ। আর এই আয়বৈষম্যের কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ জীবনমান উন্নত করার সুযোগ থেকে পিছিয়ে থাকছে গরিব পরিবারগুলো। মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি খুবই আশাব্যঞ্জক কথা।
বাংলাদেশে দ্রুত আয়বৈষম্য বাড়ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিগত ১০ বছরে আয়বৈষম্য বেড়েছে ১০ থেকে ১৬ শতাংশ। কোনো দেশের আয়বৈষম্য কতটা তা পরিমাপ করা হয় গিনি সহগ দিয়ে। গিনি সহগের মান শূন্য হলে বোঝায় যে, দেশের সবার মধ্যে চরম সমতা বিরাজ করছে; আর এর মান বাড়তে বাড়তে শূন্য দশমিক পাঁচ (০.৫) বা বেশি হলে বোঝায় যে, দেশে আয়বৈষম্য চরমতম অবস্থায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৪ সালে দেশে গিনি সহগের মান ছিল দশমিক ২৪। ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছিল দশমিক ৪৫৮। ২০১৬ সালে তা আরও বেড়ে হয়েছে দশমিক ৪৮৩। ২০১৬ সালে দেশে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ পরিবারের হাতে ছিল আয়ের ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ সময় সবচেয়ে সম্পদশালী পাঁচ শতাংশ পরিবারে আয় বেড়ে হয়েছে ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যেখানে সবচেয়ে গরিব পাঁচ শতাংশ পরিবারে আয় কমে হয়েছে দশমিক ২৩ শতাংশ মাত্র। আয়বৈষম্যের এ চিত্র শহরের চেয়ে গ্রামে আরও বেশি তীব্র। এ সময় গ্রামাঞ্চলে গিনি সহগ দশমিক ৪৩ থেকে দশমিক ৪৫-এ এবং শহরাঞ্চলে দশমিক ৪৫ থেকে দশমিক পাঁচে বর্ধিত হয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশে যেহেতু গবেষণার সময় ধনী পরিবারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সেহেতু বৈষম্যের সত্যিকার চিত্র আরও ভয়াবহ বলে অনুমান করা অসংগত নয়।
বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে প্রভূত উন্নতি করেছে, প্রবৃদ্ধির হিসাবে অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির সুফল বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পায়নি, পেয়েছে গুটিকয়েক মানুষ। মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা বরাবরই লেজেগোবরে। অনেকে দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ে। তাদের গড় সম্পদ বেশি বলে হিসাব করা হয়। এতে হকার, রিকশাচালক, গার্মেন্ট শ্রমিক ও বেকার সবাইকে মধ্যবিত্ত দেখানো হয়। আর মাঝখান থেকে ফুলেফেঁপে ওঠার দৃশ্যটা ঢাকা পড়ে যায়।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিকরা জিডিপি বৃদ্ধির ব্যাপারে যেমন উৎসাহ প্রকাশ ও হইচই করে থাকেন, যখন সাফল্য আসে তখন কিন্তু বৈষম্য বৃদ্ধিতে তাদের তেমন উদ্বেগ পরিলক্ষিত হয় না। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চয় জিডিপি হিসাব করার সময় গণ্য করা হয়। কিন্তু কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেয়ে যে সর্বস্বান্ত হয়, সেটা কোনো বিবেচনায় আনা হয় না। একটি দেশকে আধা উন্নত বা উন্নত এই খেতাব দেওয়ার আগে দেখা উচিত যে দুর্বল ও বঞ্চিত শ্রেণির নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের ভিত কতটা মজবুত হয়েছে; মৌলিক চাহিদা মেটানোর পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না।
উদার গণতন্ত্রের ওপর উদার অর্থনীতির প্রভাব অত্যন্ত বেশি। নির্বাচনে অর্থের ছড়াছড়ি দেখলে এ বিষয়টি নিয়ে আর বিতর্কের অবকাশ থাকে না। আর সে কারণে রাজনীতিকরা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়টি নিয়ে কম আগ্রহ দেখায়। সে জন্য এই বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজন শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন। সেখানেও যে লুটেরাদের কালো থাবা পড়বে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে চেষ্টা চালাতে হবে।
আধুনিককালের একটা বড় সুবিধা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিস্তার। এর ফলে আমরা জানতে পারি পানামা কেলেঙ্কারি ও প্যারাডাইস কেলেঙ্কারির মাধ্যমে লুটেরা কী পরিমাণ সম্পদ পাচার করে থাকে। এটাও একটা পরোক্ষ প্রতিরোধ বলা যেতে পারে।
নানা অপকৌশলে কিছু লোক শুধু শুধু টাকা পায়, আর কিছু লোক টাকা হারায়! বিবিএস প্রতি বছর যেভাবে জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের সাময়িক হিসাব করে থাকে, তেমনিভাবে যদি ঘুষ, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হতো তাহলে ওই শ্রেণির লোকগুলো এক ধরনের নৈতিক চাপের মধ্যে থাকত। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত পাঁচ দশকে আমরা আরও বড় লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম, যদি আমরা দুর্নীতিটা দূর করতে পারতাম।
মাথাপিছু আয় বাড়ার খবরটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। সরকারকে আয়বৈষম্যের ব্যাপারটিতেও লক্ষ রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে সুষম সামাজিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ একটি সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হোকÑএটাই সবার প্রত্যাশা।
ব্যাংকার ও কলাম লেখক