মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি বনাম গরিবের আয়বৈষম্য

মো. জিল্লুর রহমান: সম্প্রতি প্রকাশিত এক তথ্যে বলা হয়েছে, বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৭৮৪ মার্কিন ডলার, টাকার হিসাবে তিন লাখ ছয় হাজার ১৪৪ টাকা। আমাদের অনেকের ধারণা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মানেই দেশ অনেক উন্নত হয়েছে, কিংবা মানুষের জীবনমানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মজার বিষয় মাথাপিছু আয় বেশি হওয়া মানেই যে কোনো দেশের মানুষ খুব ভালো আছে, তা নয়। ধরা যাক, একজনের আয় ৯ হাজার টাকা। আরেক জনের আয় এক হাজার টাকা। এর অর্থ দুজনের মাথাপিছু গড় আয় পাঁচ হাজার টাকা। তার মানে তো এই নয় যে, দুজনেরই আয় সমান। সুতরাং এখানেই আয়বৈষম্যের বিষয়টি চলে আসে। সুতরাং মনে রাখতে হবে, জাতীয় আয় বৃদ্ধিই উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন আরও অনেক বড় বিষয়।

আসলে মাথাপিছু আয় বলতে সাধারণত কোনো দেশের মোট আয়কে জনপ্রতি ভাগ করে দিলে যা হয়, তাকে বোঝায়। জনগণের সর্বমোট ব্যক্তিগত আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। সাধারণত মাথাপিছু আয়কে প্রতিবছর টাকার এককে প্রকাশ করা হয়। পক্ষান্তরে মোট দেশজ উৎপাদন (ইংরেজিতে জিডিপি) হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের অভ্যন্তরে বা ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে বসবাসকারী সকল জনগণ কর্তৃক উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের অর্থমূল্যের সমষ্টি। এতে ওই সীমানার মধ্যে বসবাসকারী দেশের সকল নাগরিক এবং বিদেশি ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের মূল্য অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে বিদেশে অবস্থানকারী ও কর্মরত দেশের নাগরিক/সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের আয় অন্তর্ভুক্ত হবে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৮৪ মার্কিন ডলার, যা গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল দুই হাজার ৭৪৯ ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল দুই হাজার ৭৯৩ ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল দুই হাজার ৫৯১ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে এই আয় ৩৫ ডলার বেড়েছে। ডলারের দাম ১০৯ টাকা ৯৭ পয়সা ধরে এই মাথাপিছু আয় টাকার হিসাবেও গণনা করা হয়েছে। বর্তমানে টাকার অঙ্কে মাথাপিছু গড় আয় তিন লাখ ছয় হাজার ১৪৪ টাকা।

যদিও সঠিক জাতীয় আয়ের হিসাবটা খুব একটা সহজ কাজ নয়, বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। যেমন দ্বৈত গণনা সমস্যা। জাতীয় আয় গণনার ক্ষেত্রে অনেক সময় একটি দ্রব্য দুবার গণনা করা হতে পারে। যেমন বই ও কাগজের ক্ষেত্রে যদি বই ও কাগজের মূল্য উভয়ই জাতীয় আয়ের মধ্যে গণনা করা হয়, তাহলে জাতীয় আয়ের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। কারণ বইয়ের মূল্যের মধ্যে কাগজের মূল্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একবার কাগজের মূল্য এবং সেই সঙ্গে বইয়ের মূল্য পৃথকভাবে হিসাব করা হলে প্রকৃতপক্ষে কাগজের মূল্য দুবার গণনা করা হয়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৭৮৪ মার্কিন ডলার। কিন্তু সমাজে বিশেষ করে নিম্ন-আয়ের মানুষের কতটা অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে, তা বাস্তবে দেখলেই অনুমান করা যায়।

বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৯৭২ সালে ছিল প্রায় ১২৯ ডলার, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৮৪, অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় সাড়ে ২১ গুণ বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি। ওই সময়ে হতদরিদ্রের হার কমে শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।

কোনো দেশের আয়বৈষম্য কতটা তা পরিমাপ করা হয় গিনি সহগ দিয়ে। গিনি সহগের মান শূন্য হলে বোঝায়, দেশের সবার মধ্যে চরম সমতা বিরাজ করছে; আর এর মান বাড়তে বাড়তে শূন্য দশমিক পাঁচ (০.৫) বা বেশি হলে বোঝায় যে, দেশে আয়বৈষম্য চরমতম অবস্থায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ, ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ধনীদের আয় আরও বেড়েছে। এতে আয়বৈষম্য আরও বেড়েছে। যেমন দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে এখন মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। সব মিলিয়ে সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ আয় যাচ্ছে দেশের ধনী ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে। বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের বাকি এক ভাগ। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। সে অনুযায়ী ছয় বছরে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী কমেছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে এখন দরিদ্র জনগোষ্ঠী ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। জরিপে দেখা যায়, দেশে আয়ের ক্ষেত্রে ২০২২ সালে গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৯৯, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২ এবং ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। ১৯৭৪ সালে দেশে গিনি সহগের মান ছিল শূন্য দশমিক ২৪। এতে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। অন্যদিকে ২০২২ সালে ভোগ ব্যয়ের জন্য গিনি সহগের মান ছিল শূন্য দশমিক ৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪ এবং ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২১।

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে সুষমভাবে সম্পদ বণ্টিত হচ্ছে কি না, সেটা মানুষের জীবনমান উন্নয়নের মৌলিক ভিত্তি। কারণ ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলথ এক্স ইনস্টিটিউট নামের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে তাদের প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে ধনী তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ১০টি দেশের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ। তাদের মতে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অতি ধনী বেড়েছে বার্ষিক ১৪ দশমিক তিন শতাংশ হারে। এখানে অতি ধনী বলতে তাদের বোঝানো হয়েছে, যাদের মোট সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৫০ কোটি টাকা। নানা পরিসংখ্যানে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ। আর এই আয়বৈষম্যের কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ জীবনমান উন্নত করার সুযোগ থেকে পিছিয়ে থাকছে গরিব পরিবারগুলো। তাই মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি যদিও আশাব্যঞ্জক কথা, কিন্তু একইসঙ্গে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি সেরকমই হতাশার খবর।

২০২৩ সালের মে মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিগত চার বছরে ধনী-গরিব সবার আয় বাড়লেও সে তুলনায় আয় বাড়ার হার সবচেয়ে কম নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তবে সব শ্রেণির মানুষেরই খরচ বেড়েছে এবং আয়বৈষম্যও বেড়েছে। বিআইডিএসের গবেষণায় ২০১৯ সালে যেসব পরিবারের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল, ২০২২ সালে আবারও সেই একই পরিবারগুলোর ওপর জরিপ চালানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালের জরিপে যাদের ধনী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল, তাদের বার্ষিক আয় ছিল আট লাখ ৫৪ হাজার ১৪৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতিমাসে আয় ছিল ৭১ হাজার টাকার মতো। তবে ২০২২ সালে এসে তাদের বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ টাকার বেশি। অর্থাৎ তাদের প্রায় ৬৪ শতাংশ আয় বেড়েছে। অন্যদিকে যারা ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত’, ২০১৯ সালে যাদের বার্ষিক আয় ছিল চার লাখ দুই হাজার টাকা, ২০২২ সালে তাদের আয় হয়েছে চার লাখ ৩৮ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ধনীদের মতো এত বেশি আয় বাড়েনি আর কোনো শ্রেণির, যার অর্থ হচ্ছে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে এবং গরিব ও মধ্যবিত্তদের সঙ্গে তাদের আয়ের পার্থক্যও বেড়েছে আরও।

বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে প্রভূত উন্নতি করেছে, প্রবৃদ্ধির হিসাবে অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির সুফল বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পায়নি। পেয়েছে গুটিকয়েক মানুষ। মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা বরাবরই লেজেগোবরে। অনেকে দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ে। তাদের গড় সম্পদ বেশি বলে হিসাব করা হয়। এতে হকার, রিকশাচালক, গার্মেন্ট শ্রমিক, বেকার সবাইকে মধ্যবিত্ত দেখানো হয়। আর মাঝখান থেকে ফুলেফেঁপে ওঠার দৃশ্যটা ঢাকা পড়ে যায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিকরা জিডিপি বৃদ্ধির ব্যাপারে উৎসাহ প্রদর্শন ও হৈচৈ করে থাকেন। কিন্তু যখন সাফল্য আসে, তখন কিন্তু বৈষম্য বৃদ্ধিতে তাদের উদ্বেগ পরিলক্ষিত হয় না। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চয় জিডিপি হিসাব করার সময় গণ্য করা হয়। কিন্তু কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেয়ে যে সর্বস্বান্ত হয়, সেটা কোনো বিবেচনায় আনা হয় না। একটি দেশকে আধা উন্নত বা উন্নতÑএই খেতাব দেয়ার আগে দেখা উচিত যে দুর্বল ও বঞ্চিত শ্রেণির নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের ভিত কতটা মজবুত হয়েছেÑমৌলিক চাহিদা মেটানোর পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি না।

নানা অপকৌশলে কিছু লোক শুধু শুধু টাকা পায়, আর কিছু লোক টাকা হারায়! বিবিএস প্রতি বছর যেভাবে জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের সাময়িক হিসাব করে থাকে, তেমনিভাবে যদি ঘুষ, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হতো তাহলে ওই শ্রেণির লোকগুলো এক ধরনের নৈতিক চাপের মধ্যে থাকত। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত পাঁচ দশকে আমরা আরও বড় লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম, যদি আমরা দুর্নীতিটা দূর করতে পারতাম। মাথাপিছু আয় বাড়ার খবরটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। তবে সরকারকে আয়বৈষম্যের ব্যাপারটিতেও লক্ষ রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ হতে হবে, সুষম সামাজিক উন্নয়ন ও বাজেটের সুষম বণ্টন। কর্মহারা মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হোক, ধনী-গরিবের বৈষম্য কমে আসুক, এটাই প্রত্যাশা।

ব্যাংকার ও কলাম লেখক

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০