ইসমাইল আলী: ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৩তম বৃহৎ অর্থনীতি। আর চলতি মূল্যে এ অবস্থান ৪৫তম। অথচ ১৯৭২ সালে এ অবস্থা ধারণার মধ্যেই ছিল না। বরং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের নেতিবাচক উপাধি জুটেছিল বাংলাদেশের কপালে। যদিও সে অবস্থা ঘুরে দাঁড়াতে অনেকটা সময় লেগে যায়। নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ে উন্নীত হতেই লেগেছে ৪৪ বছরের বেশি। তবে এর পরের তিন বছর দ্রুত এগিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
স্বাধীনতার ৪৬ বছরে দেশের অর্থনীতিতে মৌলিক কিছু পরিবর্তনও এসেছে। কৃষি থেকে সেবা ও শিল্প খাতের বিকাশ হয়েছে। যদিও স্বাধীনতার ৪৬ বছরে অর্থাৎ ২০১৭ সালে কেমন হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি এ নিয়ে কোনো পূর্বাভাস দুই দশক আগেও ছিল অকল্পনীয়। যদিও সে অসম্ভবকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল ছয় দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলারে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে বেড়েছে মাথাপিছু আয়ও। ১৯৭১ সালে যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল ৭০ ডলার, এখন তা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৬১০ ডলার। অর্থাৎ ৪৬ বছরে ২৩ গুণ হয়ে গেছে মাথাপিছু আয়।
এর মধ্যে আড়াই বছর আগেই আসে সুসংবাদ। ২০১৫ সালের ১ জুলাই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয় বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪৫ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ায় এ স্বীকৃতি দেয় বিশ্বব্যাংক। অর্থনীতির এ গতিকে আরও ওপরে তুলে ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ।
তবে এ পথে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্বাধীনতার ৭০ বছরের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে দুটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। প্রথমত, ৮-১০ শতাংশ হারে ১৫-২০ বছর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধির সুফলকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই এ লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে।
যদিও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অর্থনীতির ৪৬ বছরের অর্জনকে বিস্ময়কর বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ বা ৭৩ সালে কল্পনাই করা যেত না ৪৬ বছর পর বাংলাদেশ কোথায় থাকবে। নানা ধরনের আশঙ্কাও করা হয়েছিল সে সময়। তবে সব ধরনের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে আজকের অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। এখন সাফল্যের বিভিন্ন ধরনের উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশকে তুলনা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কোনো ধরনের অবকাঠামো ছিল না। বড় কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও ছিল না। শিক্ষার হার ছিল অনেক কম। দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় শতভাগ। সেখানে থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অবশ্যই অনেক চ্যালেঞ্জের। আর সেটা খুব ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর প্রথম তিন বছর বাংলাদেশের জিডিপির আকার মোটামুটি দ্রুত বাড়ে। মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে বিনিয়োগ করায় এটি অর্জন সম্ভব হয়েছিল। এতে মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে দ্রুত। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৪৪৮ বিলিয়ন ডলার। আর সে সময় মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২০০ ডলার।
এরপর তিন বছর কমে মাথাপিছু আয়। ১৯৭৮ সালে তা ১৬০ ডলারে নেমে আসে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে এর জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ১৯৭৯ সাল থেকে আবার মাথাপিছু আয় বাড়তে থাকে। ১৯৮১ সালে তা ২৬০ ডলারে পৌঁছায়। আর সে বছর জিডিপির আকার ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আবার তিন বছর মাথাপিছু আয় হ্রাস পায়।
এর পর থেকে নিয়মিতই বাড়ে জিডিপি ও মাথাপিছু আয়। তবে ২০০২ সাল পর্যন্ত এ গতি ছিল বেশ মন্থর। কারণ ওই সময় জিডিপির আকারও অনেক ধীরগতিতে বেড়েছে। এর মধ্যে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৩১০ ডলার। আর ২০০০ সালে এর আকার বেড়ে দাঁড়ায় ৪২০ ডলার। পরের বছর ১০ ডলার বাড়লেও ২০০২ সালে তা আবার কমে ৪২০ ডলারই হয়।
২০০২-এর পর থেকে জিডিপির আকার ও মাথাপিছু আয় দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ২০০৫ সালে মাথাপিছু আয় প্রথম ৫০০ ডলার অতিক্রম করে। সে সময় এর পরিমাণ ছিল ৫৩০ ডলার। পরের আট বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে এক হাজার ডলার ছাড়ায়। ফলে ২০১৩ সালে মাথাপিছু আয় এক হাজার ১০ ডলারে পৌঁছে। এরপর চার বছরে তা দেড়গুণ ছাড়িয়ে গেছে। এতে চলতি বছর মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬১০ ডলার।
তবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই অর্থনীতির সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এটা শুধু আয় বৃদ্ধি বোঝায়। তবে প্রবৃদ্ধি সুফল নিশ্চিত করতে এর সুষ্ঠু বণ্টনও দরকার। তা না হলে আয়-বৈষম্য সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধান বাড়াবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থানের পেছনে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন। এর প্রথমটি ছিল কৃষিতে সবুজ বিপ্লব। আর দ্বিতীয়টি নীরব শিল্পবিপ্লব। পাশাপাশি শিল্পকে সহায়তা করতে সেবা খাতও প্রসারিত হয়েছে।
কৃষির সাফল্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কৃষি ছিল মূলত প্রকৃতিনির্ভর। শুষ্ক মৌসুমে কোনো ফসল হতো না। অনাবৃষ্টিতে কোনো কোনো বছর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও জেগে বসত। আর এখন দেশের প্রায় সব জমি তিন ফসলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমেও ফসল ফলছে। প্রতিবছর আবাদি জমি হ্রাস ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরও চালে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, ১৯৭২ সালে যা ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়।
আর বাংলাদেশের শিল্প খাতের সাফল্যকে ব্রিটেনের প্রথম শিল্পবিল্পবের সাফল্যের চেয়েও বড় বলে মনে করে ড. জাহিদ হোসেন। এর কারণ ব্যাখ্যায় দুই দেশের জিডিপিতে শিল্পের অবদান তুলনা করে তিনি বলেন, ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সালে ব্রিটেনে প্রথম শিল্পবিপ্লব হয়। ওই সময়ে অর্থাৎ ৮০ বছরে দেশটিতে শিল্প খাতের অবদান বেড়েছিল ১১ শতাংশ। এর মধ্যে ১৭৬০ সালে ব্রিটেনের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২০ শতাংশ। ১৮৪০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ শতাংশে। আর ৪৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান বেড়েছে ২৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল মাত্র ছয় শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ শতাংশ। এটাকে অবশ্যই শিল্পবিল্পব।