রতন কুমার দাস: ১৯৯২ সালের মাঠের মতো এবার রাজনীতিতেও সসম্মানে টিকে থাকার লড়াইয়ে উতরে গেলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তবে পুরো ইনিংস খেলা হলো না তার—অতীতের সব প্রধানমন্ত্রীর মতো তিনিও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না। কিন্তু অন্য কারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ‘শখ’ও মিটিয়ে দিলেন।
ক্রিকেট মাঠের মতো পাকিস্তানের রাজনীতিতেও তাকে রক্ষাকর্তা মনে করা হয়েছিল। দেশবাসীর ভরসাও হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও বহিঃচাপে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। উপরন্তু তার দলের ভেতরে ও সেনাবাহিনীতে মার্কিন লবি বেশ সক্রিয়। তাছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে পুতিনের পক্ষ নেয়া ও সরাসরি মার্কিন সরকারের সমালোচনা করাও তার কাল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে শেষ মুহূর্তে ম্যাচ বাঁচিয়ে নিলেন ১৯৯২ সালের বিশ্বজয়ী পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন। সংসদে তার বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দিলেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি। প্রেসিডেন্টকে দিয়ে অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেয়ার সুইংয়ে চুপসে গেল বিরোধীরা। ক্ষমতাচ্যুত না হলেও প্রধানমন্ত্রী থেকে ইমরান খান হয়ে গেলেন ‘কেয়ারটেকার প্রাইম মিনিস্টার’। মাথা উঁচুই থাকল তার।
এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল, তার আপাত-সমাপ্তি ঘটল নাটকীয়ভাবে। অনাস্থা ভোটের পরিবর্তে সরকার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার ঘোষণা দিল। আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি হয়ে গেল পাকিস্তানের সংসদ।
পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন ও জিও নিউজের খবরে বলা হয়, গতকাল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ইমরান। এতে দেশবাসীকে ভোটের জন্য তৈরি হতে বলেন। বলেন, ‘ঘাবড়ানা নেহি হ্যায়। উপরওয়ালা পাকিস্তানের ওপর নজর রেখেছেন।’ এরপর বলেন, দেশবাসীই স্থির করুন, তারা কাকে ক্ষমতায় দেখতে চান। বিরোধীরা এই নাটকীয় পটপরিবর্তনকে মানতে পারছেন না। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বিলাওল ভুট্টো জারদারি বলেন, বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন। পাকিস্তানি শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতিও এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন।
ইমরানের বিরুদ্ধে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ)। প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসেবে শোনা যায় নওয়াজের ভাই শাহবাজের নামও। লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির জন্য গত ৮ মার্চ ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন দেশটির বিরোধী দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সেক্রেটারিয়েটে এ প্রস্তাব জমা দেন তারা। তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রায় ১০০ আইনপ্রণেতা। এ প্রস্তাব আসার পর ইমরান খান বলেন, এভাবে তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। এতে বরং তার সরকার আরও শক্তিশালী হবে। আমাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য এটা বিরোধীদের শেষ চেষ্টা। আমরা তাদের এমনভাবে পরাজিত করব যে, তারা ২০২৮ সাল পর্যন্ত আর কিছু করতে পারবে না। এই বিরোধীদের সঙ্গে কিছু বিদেশি শক্তিও জড়িত বলে দাবি করেন তিনি।
পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন জানায়, এর আগে গত বছর মার্চেও একবার অনাস্থা ভোট আনা হয় ইমরান খানের বিরুদ্ধে। তখন তিনি ১৭৮ ভোট পেয়েছিলেন, প্রয়োজনীয় ভোটের চেয়ে যা ছয়টি বেশি ছিল। এবারের এই অনাস্থা প্রস্তাবের ওপরও ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল। প্রসঙ্গত পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সদস্য সংখ্যা ৩৪২।
বিশ্বকাপ জয়ের চার বছর পর ১৯৯৬ সালে রাজনীতি শুরু করেন ইমরান। দুর্নীতিবিরোধী স্লোগান তুলে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ। ১৯৯৭ সালে তিনি নির্বাচনে দুটি কেন্দ্র মিয়াওয়ালি ও লাহোর থেকে দাঁড়ান এবং হেরে যান। পরের নির্বাচনে ২০০২ সালে মিয়াওয়ালি থেকে জয়ী হন। প্রথমে সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফকে সমর্থন দিলেও ২০০৭ সালে ৮৫ সংসদ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পদত্যাগ করেন ইমরান। সেই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হয়ে মোশাররফ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। গৃহবন্দি করা হয় ইমরানকে। হাজতবাসও করতে হয় তাকে। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের দশম নির্বাচনে তার দল দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের মর্যাদা হয়। ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানের একাদশ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন তিনি। ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার আগে ও পরে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের কথা বলেন ইমরান খান। গণতান্ত্রিক সরকারে সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তিনি বরাবর সোচ্চার। এসব কারণে বারবার হোঁচট খেয়েছেন। আবার সুযোগ বুঝে নওয়াজকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের আরও কাছেও চলে আসেন।
তবে গতকাল ও এর আগে এক মাস ধরে যা ঘটেছে, তা থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। আইএসপিআর জানায়, দেশের রাজনীতিতে যা ঘটছে তাতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নেই।