মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে যা ভাবতে হবে

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের একের পর এক অসংগতিমূলক সিদ্ধান্তের কবলে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়েছে। ২০১৩ সালে মাদরাসা শিক্ষার উৎকর্ষ ধরে রাখতে এই স্বতন্ত্র বোর্ডের পদচারণা শুরু হয়। নানা অভিযোগ ও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে কয়েক বছর ধরে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে ভাবুক বিশ্লেষক মহলে এ বিষয়ে রীতিমতো আলোচনা চলছে। সম্প্রতি দুটি বিষয় নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একটি পরীক্ষার সময়সূচি (রুটিন) তৈরিতে অদূরদর্শিতা এবং অন্যটি আরবি প্রভাষক পদে অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত।

গত মে মাসে প্রকাশিত রুটিন অনুযায়ী ফাজিল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল ২৯ জুলাই। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, যেদিন সরকারি ছুটিতে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি অফিসগুলোর কার্যক্রম বন্ধ থাকে, সেদিনে পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়। খ্রিষ্টীয় সনের দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী ২৯ তারিখে আশুরার বন্ধ দেখা যায়। এটি পরিবর্তনশীল তাৎক্ষণিক কোনো বন্ধের দিবস নয়, পূর্বনির্ধারিত ঐতিহাসিক দিবসকে কেন্দ্র করে দিনটিকে সরকারি ছুটি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বিবদ্যালয় প্রশাসনের বিলাসিতার কারণে ওই দিবসে পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে বিশেষজ্ঞদের নজরে ধরা পড়লে রুটিনে পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়। তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরদর্শিতা, অমনোযোগিতা, বিলাসিতা ও দায়িত্বহীনতা নিয়ে নানা প্রশ্ন থেকে যায়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন কমিটি একটি সুনিপুণ রুটিন তৈরিতে ব্যর্থ, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা ও শিক্ষা কার্যক্রমে অসংগতি থাকা অস্বাভাবিক নয়, যেটি শিক্ষার্থীদের জনমনে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এবং একপর্যায়ে পড়াশোনা থেকে ইতি টানতে বাধ্য করে। বছরের পর বছর ধরে সেশনজট লেগে থাকার পর এমন বিচ্যুতি ভরা রুটিনই প্রমাণ করে, বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার নিয়ে মোটেও চিন্তা করে না। মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্য ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। নচেৎ এভাবে অধঃপতিত হতে থাকলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এই শিক্ষাব্যবস্থা খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে যাবে।

আলোচনায় অন্য যে বিষয়টি গভীর উদ্বেগের জš§ দিয়েছে, তা সংঘটিত হয়েছে গত ১৯ জুলাই ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে একটি প্রবিধান প্রকাশকে কেন্দ্র করে। সেখানে খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে দুর্বল একটি বিধান সংযোজন করা হয়েছে। এত দিন আলিম, ফাজিল ও কামিল শ্রেণির আরবি প্রভাষক পদে শুধু আরবি বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরা আবেদন করতে পারতেন এবং ওই পদে নিয়োগ নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। দুঃখজনক বিষয় হলো যৌক্তিক এই নিয়মকে পাশ কাটিয়ে ইসলামিক স্টাডিজ থেকে ডিগ্রিধারীদেরও ওই পদে আবেদনের সুযোগ দেয়া হয়েছে, যেটি অন্যায় ও নিয়মের ব্যত্যয়। কেননা উচ্চশ্রেণির পাঠদানে যে যোগ্যতা থাকা দরকার, সে যোগ্যতা আরবি বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগের ডিগ্রিধারীদের নেই। যারা আরবি সাহিত্যের দীর্ঘ ইতিহাস, কাব্য অলংকার, ছন্দের বিন্যাস ও শৈল্পিক বিশ্লেষণ নিয়ে কখনও পড়াশোনা করেনি, তারা কি আদৌ নবাগত আরবি শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশিত মানে শিক্ষাদান করতে পারবেন?

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রতিভা বিকাশের সুনির্দিষ্ট জায়গায় খালি আছে। তাদের নতুন করে অন্য বিভাগে পদায়ন করা হলে এটি তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। এতে শিক্ষকের সম্মান ও যোগ্যতার প্রভাব নিয়ে টানাপড়েন তৈরি হওয়া খুবই প্রাসঙ্গিক। তাদের স্থলে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা যেরূপ আবেদন করতে পারে না, তদ্রƒপ অন্য যেকোনো বিভাগের পদেও তাদের আবেদনের সুযোগ দেয়াটি যথার্থ কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। যারা দীর্ঘকাল ধরে আরবি থেকে বিমুখ ছিল, তাদের আরবি বিভাগে সুযোগ দেয়াটি শিক্ষার সঙ্গে তামাশার শামিল। আরও একটি সমস্যা হলো, ইসলামিক স্টাডিজে শুধু মাদরাসা শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেছে, তা কিন্তু নয়। এই বিভাগে মাদরাসার ছাত্রদের পাশাপাশি কলেজের ছাত্ররাও কিন্তু পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়ে থাকে। তারা যদি মাদরাসার শিক্ষক বনে যান, তবেই এটি হবে মাদরাসা শিক্ষার জন্য চরম বিপর্যয়। ডাঙ্গায় যেরূপ নৌকা চলতে পারে না, অনুরূপভাবে কলেজ থেকে ইসলামিক স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করে আরবি বিভাগে পাঠদানও করাতে পারে না।

মাদরাসা শিক্ষার সমুন্নত মান ধরে রাখতে অতিসত্বর উল্লিখিত নিয়মের পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। একইসঙ্গে যারা এসব কাণ্ডজ্ঞানহীন নিয়ম করে, তাদের গহিনে জন্মে থাকা বিষাক্ত ফাঁদগুলো উম্মোচন করা দরকার। আদতে তারা মাদরাসা শিক্ষার উন্নতির নামে অবনতি করে যাচ্ছে।

আতিক উল্লাহ আল মাসউদ

শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০