মানবতা ও উন্নয়নের স্বার্থে রাশিয়া-ইউক্রেন  যুদ্ধ শেষ করতে হবে

বিশ্ব কভিড মহামারির দ্বারা বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বেড়েছে; অনাকাক্সিক্ষত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব এখন সবচেয়ে খারাপ মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এই যুদ্ধ একটি বড় মানবিক সংকট যার দ্বারা লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিশ্বের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি গুরুতর আঘাত।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম-ডব্লিউইপির তথ্য, প্রায় ২৭৬ মিলিয়ন মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছে। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন-এফ্এও’রর অনুমান অনুযায়ী যুদ্ধের প্রভাবে আরও ১১-১৯ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষ নতুন যোগ হতে পারে।

যুদ্ধ ছয় মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয়কে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। এটি বিশ্বব্যাপী ইতোমধ্যে বিদ্যমান ২৬.৪ মিলিয়ন শরণার্থীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর)-এর মতে ২০২০ সালের শেষে বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ ছিল ৮২.৪ মিলিয়ন, যার মধ্যে এক চতুর্থাংশেরও বেশি (২৬.৪ মিলিয়ন) শরণার্থী।

ডব্লিউইপির নির্বাহী পরিচালক ঘোষণা করেছেন, শরণার্থীদের জন্য খাদ্য রেশন অর্ধেকের মতো কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, কারণ ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং তহবিল সীমাবদ্ধতার কারণে ক্ষুধার্ত মানুষের সংকট বেড়ে গিয়েছে।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটস অনুসারে, ইউক্রেন বিশ্বের বৃহত্তম সূর্যমুখী তেলের উৎপাদক, রাশিয়া রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। বিশ্বে মোট উৎপাদনের ৬০ শতাংশ এ দুই দেশে হয়। এছাড়া বিশ্বব্যাপী ৪০০ মিলিয়ন মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করে ইউক্রেন, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাপী শস্য সরবরাহের ১০ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাপী ভুট্টা সরবরাহের ১৩ শতাংশ।

এফএও’র মতে, সারের মতো খামারের ইনপুটগুলোর বর্ধিত খরচ কৃষকদের উৎপাদন সম্প্রসারণ থেকে বিরত রাখতে পারে এবং রেকর্ড আমদানি বিলের সম্মুখীন দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা আরও খারাপ করতে পারে। ফলস্বরূপ, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং এশিয়ার কিছু দেশ, যেমন বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়ায়ও এর প্রভাব পড়তে পারে।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম দ্রুত বেড়েছে এবং এই বছর আরও বাড়তে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। জ্বালানি সরবরাহের সংকট বিশ্বকে ১৯৭০-এর তেল সংকটের কথা মনে করিয়ে দেয় যা বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধিকে স্থবির করে দিয়েছিল ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মধ্যেও।

ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। মিলিয়ন ডলারে মার্কিন সামরিক সহায়তা বিতরণ এবং আরও কয়েক বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রতি দেয়া, ফরাসি রাষ্ট্রপতি এবং জার্মান চ্যান্সেলরসহ ইউরোপীয় নেতারাও ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রার্থীর মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন একমুখী বিশ্বের যুগের সমাপ্তি। এই সমস্ত পদক্ষেপগুলো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে।

উন্নত দেশগুলো কয়েক দশকের মধ্যে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা ভোক্তাদের চাহিদাকে কমিয়ে দেবে। বাংলাদেশের জন্য এটি উদ্বেগের বিষয় কারণ বাংলাদেশ ওই সমস্ত দেশে রপ্তানি করে থাকে।

ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো তার বেঞ্চমার্ক সুদের হার দশমিক ৭৫ শতাংশে বাড়িয়েছে, যেহেতু বাজারের ওপর প্রভাব যাই হোক না কেন মুদ্রাস্ফীতিকে আরও জোরদারভাবে মোকাবিলা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট (বিআইএস), কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বিবেচিত, তার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ করেছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে অবশ্যই দ্রুত এবং সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করতে হবে মুদ্রাস্ফীতি গেঁথে বসার আগেই। 

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি ৭%-এ পৌঁছেছে, যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ, রাশিয়া ও ইউক্রেনে রপ্তানি হ্রাসের পাশাপাশি প্রধানত তেল ও খাদ্যের জন্য আমদানি বিল বেড়ে যাওয়ায় এটা হয়েছে।

দেশগুলো তাদের তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগের বিষয় বিবেচনায় রেখে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পশ্চিমের জন্য, এটি প্রধানত একটি নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং শক্তি এবং খাদ্য সরবরাহের বিকল্প খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা ছাড়াও তারা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কিন্তু বাকি বিশ্বের জন্য, মানবিক দুর্ভোগ এবং অর্থনৈতিক উদ্বেগ প্রথমেই আসে কারণ যুদ্ধ সমগ্র সরবরাহ শৃঙ্খলকে ব্যাহত করেছে, উৎপাদন, ব্যবসা এবং জীবনকে অস্থির করে তুলেছে।

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এবং ১০০টিরও বেশি দেশে এর ৪৫ মিলিয়ন সদস্যরা লাখ লাখ জীবন, মানবতার দুর্ভোগ এবং ক্রমাগত বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতার জন্য বিশ্ব আধিপত্যের লড়াই ত্যাগ করার জন্য পরাশক্তিদেও প্রতি আহ্বান জানান।

আইসিসিবির ত্রৈমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০