নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে মানবসম্পদে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ। এর মধ্যে শিক্ষাকে উল্লেখযোগ্য করে তিনি বলেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ কমলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বাড়ে। তাই বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। শিক্ষা সব দেশের উন্নয়নের চাবি। ভোকেশনাল, প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন। গতকাল ‘বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংকের ৫০ বছরের বন্ধুত্ব উদ্যাপন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের উন্নয়ন শুরু। ১৯৭২ সালে জিডিপি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন, বর্তমানে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। বর্তমানে বাংলাদেশ ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আমাদের দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ২০ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে। গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু। মডার্ন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ হাসিনা। এটা নিয়ে কারও প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক অনেক সহায়তা করছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের পরবর্তী টার্গেট
২০৩১ সালে বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ স্মার্ট ও ডেভেলপড বাংলাদেশ হবে। সেক্ষেত্রেও বিশ্বব্যাংকের সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে, যা তারা না করতে পারবে না।
পরে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইজারের সঞ্চালনায় প্যানেল ডিসকাশনে অংশ নেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট নিহাদ কবির, বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ড. আহমদ কায়কাউস।
প্যানেল ডিসকাশনে বিশ্বব্যাংকের এমডি বলেন, প্রাইমারি ও ভোকেশনালে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার বিতরণ ও উপবৃত্তি কর্মসূচি নিতে হবে। কারণ শিক্ষায় বিনিয়োগ কমলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বাড়ে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জলবায়ু মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক কাজ করবে বলে জানান অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ।
তিনি বলেন, উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বাংলাদেশের পাশে থাকবে বিশ্বব্যাংক। তবে বাংলাদেশকে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দারিদ্র্য।
অপরদিকে অনুষ্ঠানের পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ট্রটসেনবার্গ জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের অঙ্গভুক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) তহবিল থেকে বার্ষিক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম। সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা প্রসঙ্গে তিনি এ কথা জানান।
ট্রটসেনবার্গ বলেন, আইডিএ হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে সস্তা ঋণ। পাঁচ বছরের রেয়াতকালসহ ৪০ বছরে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে পরিশোধযোগ্য এ ঋণ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দেয়া হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক আইইডিএ-ভুক্ত দেশ বাজেট সহায়তা চায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য দেশের চাহিদাও দেখা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক এমডি বলেন, কভিড-১৯ সংকট ও ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটে অনেক দেশ বাজেট সহায়তা চায়। তারপরও আমরা সবার চাহিদার মাপকাঠির ওপর ভিত্তি করে অল্প করে বাজেট সহায়তা দেব। কভিডের কারণে অনেক দেশের অর্থ দরকার।
পদ্মা সেতুতে ঋণ না দেয়ায় বিশ্বব্যাংক কি অনুতপ্তÑএমন প্রশ্নের জবাবে ট্রটসেনবার্গ বলেন, আমি বাংলাদেশের ৫০ বছরের উন্নয়ন দেখছি। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৩৬৫ প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে একটি প্রকল্পে ঋণ দেয়া বা না দেয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ৫০ বছরে ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংক এমডি বলেন, বাংলাদেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্রতম দেশ থেকে ২০১৫ সালে নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের প্রথম উন্নয়ন সহযোগীদের অন্যতম হিসেবে এই যাত্রায় অংশীদার হতে পেরে গর্বিত। আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখেছি উন্নয়ন কীভাবে কাজ করে।
ভ্যান ট্রটসেনবার্গ বলেন, অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশ অচিন্তনীয় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর মধ্যে অন্যতম কভিড, ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন ও জলবায়ু পরিবর্তন। এসবের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জের সময়ে আমরা বাংলাদেশকে এর উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, গত পাঁচ দশকের অসাধারণ যাত্রায় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অবিচল অংশীদার ছিল। ১৯৭২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্য হয়। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক প্রথম প্রকল্প হাতে নেয়, যার মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ, কৃষি ও শিল্পের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নির্মাণ ও বিদ্যুৎ খাতের সহায়তার জন্য ৫০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি পুনরুদ্ধার ঋণ দেয়া হয়। একই সময় বিশ্বব্যাংক চারটি প্রকল্প আবার চালু করে, যা স্বাধীনতার আগে অনুমোদিত।
বিশ্বব্যাংক এমডি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রমে আইডিএ’র আওতায় অনুদান, সুদবিহীন ঋণ এবং নমনীয় ঋণ হিসাবে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ৫৬টি চলমান প্রকল্পে প্রায় ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন করছে।
এ সময় বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইজার, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান, বাংলাদেশ ও ভুটানে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক প্রমুখ বক্তব্য দেন।