‘মানবসম্পদ ব্যবস্থাপককে ধৈর্যশীল হতে হবে’

একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়।খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার মিরপুর সিরামিকস ও খাদিম সিরামিকস লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আবুল হাশেম মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস

আবুল হাশেম মজুমদার মিরপুর সিরামিকস ও খাদিম সিরামিকস লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। পরে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমবিএ, স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ও এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্টের (বিএসএইচআরএম) সম্মানিত ফেলো ও বর্তমান এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের ট্রেজারার। চাকরির পাশাপাশি তিনি দেশের একাধিক খ্যাতনামা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন

শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ারের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই…

আবুল হাশেম মজুমদার: গুলশান ক্লাব লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা বিভাগে কাজ করার মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু করি। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার কারণে ক্লাব ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করি। পরে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে চাকরি পরিবর্তনের মাধ্যমে পারটেক্স গ্রুপের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগে কাজ শুরু করি। সাত বছর মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, শিল্প সম্পর্ক ও শ্রম আইনের ওপর বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করি। ২০০৯ সাল থেকে মিরপুর সিরামিকস ও খাদিম সিরামিকস লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।

শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?

আবুল হাশেম: প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো মানবসম্পদ। মানুষই প্রতিষ্ঠানের অন্য সব সম্পদ যেমন মেশিন, জমি, অর্থ সবকিছু সঠিকভাবে পরিচালনার মাধ্যমে সফলতা নিয়ে আসে। আর এই পেশার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ পাওয়া যায়। কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সরাসরি অবদান রাখা যায়। এ কারণেই মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি।

শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বলুন…

আবুল হাশেম: প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিষ্ঠানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অর্থ, যন্ত্র ও কাঁচামাল। কিন্তু এসব সম্পদ পরিচালনা করার জন্য দরকার দক্ষ মানুষ। আর যদি এসব সম্পদ কোনো দক্ষ ও যোগ্য মানুষ পরিচালনা না করে, তবে প্রতিষ্ঠান কখনোই সফল হবে না। তাই একজন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক যোগ্য কর্মী নির্বাচন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মীদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলেন। এছাড়া নানা সুযোগ-সুবিধা ও প্রেষণার মাধ্যমে কর্মীদের প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখেন।

শেয়ার বিজ: কর্মক্ষেত্রে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয় কী?

আবুল হাশেম: কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হয়। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক কর্মী ও মালিকের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন। কর্মী ও মালিক উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপককে এগিয়ে যেতে হয়। অনেক সময় কর্মীদের নানা চাওয়া-পাওয়া থাকে। আবার মালিকপক্ষেরও নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। এসব বিষয় মাথায় রেখে কর্মীদের প্রেষণার দিক নিশ্চিত করে এগিয়ে যাওয়াটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া একজন ভালো কর্মী বাছাই করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া, কর্মীদের প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখা, তাদের মন-মানসিকতা বুঝতে পারা প্রভৃতিও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে।

শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের এইচআর প্র্যাকটিস সম্পর্কে বলুন…

আবুল হাশেম: আমাদের দেশে এইচআর প্র্যাকটিস আগের তুলনায় বেশ ভালো এবং দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় এইচআর প্র্যাকটিস বলে কিছু ছিল না। অ্যাডমিন বিভাগেই এইচআরের দায়িত্ব পালন করত। তখন তারা আইন-কানুন বাস্তবায়নের পাশাপাশি কেবল ম্যানেজমেন্টের নির্দেশ অনুযায়ী কর্মী বাছাই-ছাঁটাই করত। এরপর পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট আসে। তখন এ বিভাগ কিছুটা মানুষকে নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এরপর থেকেই বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচআর-বিষয়ক নানা কোর্স চালু হতে শুরু করে। তারপর আজকের এই মানবসম্পদ বিভাগ। এখন যোগ্য কর্মী নির্বাচন, এমপ্লয়ি বেনিফিট, কর্মীদের মধ্যে বেস্ট পারফরমার নির্ণয়, তাদের ক্যারিয়ার পাথ দেখানো, মোটিভেশন, এমপ্লয়ি এনগেজমেন্ট প্রভৃতি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এতে করে প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও উপকৃত হচ্ছেন। তবে সব প্রতিষ্ঠানে যে সঠিক চর্চা হচ্ছে তা বলব না। কিন্তু দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও এইচআরের সঠিক চর্চা বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করছি।

শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপককে কীভাবে মূল্যায়ন করেন।

আবুল হাশেম: মহৎ পেশা এটি। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক হতে হলে প্রথমে ভালো মানুষ হতে হবে। যেহেতু মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক মানুষ নিয়ে কাজ করেন, তাই মানুষের ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা, আবেগ-অনুভূতি-সংস্কৃতি সবকিছু বুঝে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়। এ পেশার মাধ্যমে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশা যায়, মানুষকে জানা যায়। অনেকের ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে ভূমিকা রাখা যায়। অন্য বিভাগের মাধ্যমে এভাবে কাজ করার সুযোগ কম থাকে। তাই বলতে চাই এটি একটি মহৎ ও চমৎকার পেশা। আমি এ পেশাকে বেশ উপভোগ করছি।

শেয়ার বিজ: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন…

আবুল হাশেম: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের স্বাগত জানাই। ক্যারিয়ার শুরুর আগে এইচআর-বিষয়ক পড়ালেখা প্রয়োজনীয় কোর্স বা ডিগ্রি নেওয়া উচিত। শ্রম আইন বিষয়ে দক্ষতার পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে মেশা, কথা বলা, অন্যের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাওয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। এইচআর যেহেতু সবাইকে নিয়ে কাজ করে এবং সব বিভাগের সঙ্গে তাকে কাজ করতে হয়, তাই এ পেশার মানুষকে অবশ্যই ভাষা, অঙ্গভঙ্গি ও আচার-ব্যবহারে অনেক সচেতন থাকতে হয়।

শেয়ার বিজ: সফল মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের মধ্যে কী কী গুণ থাকা জরুরি বলে মনে করেন?
আবুল হাশেম মজুমদার: সফল হতে হলে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপককে ধৈর্যশীল হতে হবে। নানা দিক থেকে নেতিবাচক কথা শুনতে পারেন তিনি। এজন্য অবশ্যই তাকে আশাবাদী হতে হবে। কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টে সক্ষমতা থাকতে হবে। কনসেপচুয়াল স্কিল, হিউম্যান স্কিল ও টেকনিক্যাল স্কিল তার মধ্যে এ তিনটি গুণ থাকা জরুরি। কনসেপচুয়াল স্কিল বলতে কর্মক্ষেত্রে অনেক সময় এমন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যার সমাধান কোনো বইয়ে থাকে না, বরং একজন ম্যানেজারকে উপস্থিত বুদ্ধির মাধ্যমে এর সমাধান করতে হয়। টেকনিক্যাল স্কিল বলতে মানবসম্পদ সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হওয়া বোঝায়। আর হিউম্যান স্কিল বলতে মানুষকে বুঝতে পারা, মানুষকে নিয়ে কাজ করার দক্ষতাকে বোঝায়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০