মানবাধিকার, বঙ্গবন্ধু ও মানবিক মূল্যবোধ

নাছিমা বেগম: ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারের মূল সুর হলো, প্রতিটি মানুষের সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার। মানুষ হিসেবে এই অধিকার প্রত্যেকের প্রাপ্য, যা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। মানবাধিকার শাশ্বত এবং কোনো দেশের সীমারেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ, শিশু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, আদিবাসী, তৃতীয় লিঙ্গ, প্রতিবন্ধী যা-ই হোন না কেন, তিনি গ্রাম বা শহর বা বিশ্বের যে প্রান্তেই বসবাস করেন না কেন, মানুষ হিসেবে সবার সমান অধিকার।

মানবাধিকার মূলত একদিকে জীবনের অধিকার, অন্যদিকে স্বাধীনভাবে কথা বলার, চলাফেরা করার এবং অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যÑসবকিছুর অধিকার। কার্যত অধিকার ও দায়িত্ব একে অন্যের পরিপূরক। অধিকার পূরণের ক্ষেত্রে অধিকার প্রদানকারীর যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি অধিকার ভোগকারীরও দায়িত্ব রয়েছে। উভয়পক্ষের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন ছাড়া অধিকার বাস্তব রূপ পায় না।

মানবাধিকার একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি অনেক ব্যক্তির সমষ্টি জনগণের জন্যও সমানভাবে কার্যকর। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নিজের কোনো সুবিধা আদায়ের জন্য কখনও সংগ্রাম করেননি। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন সাধারণ জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য।

কারা সদর দপ্তর থেকে প্রকাশিত ‘জাতির পিতার সমগ্র জেল জীবন ৩০৫৩ দিন’ গ্রন্থের তথ্য প্রণিধানযোগ্য। এতে বলা হয়েছে, তিনি নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কখনও সংগ্রাম করেননি, সংগ্রাম করেছেন জনদাবি আদায়ের জন্য। জনস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের, বিশেষ করে যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো তাকে কারাযাপন করতে হয়েছে। বাংলা ও বাঙালির অধিকার, বিশেষ করে জনদাবি আদায়ে বঙ্গবন্ধুর এই আত্মত্যাগের বিবরণ বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দুটিতে উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু জনদাবি আদায়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন এবং সফল হয়েছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু অনশন শুরু করে যখন প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী, তখন পাকিস্তানের শাসকরা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবাধিকার সংগ্রামের ফসল হিসেবে। আর এই ফসল ফলিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক, উদ্দীপক ও মহানায়ক ছিলেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবসত্তার মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আর এগুলোর সমষ্টিই হলো মানবাধিকার। স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র ১০ মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত ৩০টি অনুচ্ছেদ-সংবলিত সর্বজনীন মানবাধিকার দর্শনের পুরোপুরি প্রতিফলন রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পাদন না করলে অধিকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবাইকে দায়িত্ব সম্পাদন করতে হবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা যদি একটু কষ্ট করি, একটু বেশি পরিশ্রম করি, সকলেই সৎপথে থেকে সাধ্যমতো নিজের দায়িত্ব পালন করি এবং আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি ইনশাল্লাহ কয়েক বছরেই আমাদের স্বপ্নের বাংলা আবার সোনার বাংলায় পরিণত হবে।’

বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। পাকিস্তান শাসনামলের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে ও স্বাধীনতা-উত্তর দেশ গঠনে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন, সেই বক্তব্যের নির্যাস থেকেই তা প্রতীয়মান হয়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকেই বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন। বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা স্থান পাবে না, এ বিষয়ে তার প্রত্যয় ছিল অবিচল। বঙ্গবন্ধু বলতেন, এ রাষ্ট্রের মানুষ হবে বাঙালি। তাদের মূলমন্ত্র হবেÑ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার দৃষ্টিতে সব ধর্মই সমান এবং সম-অধিকারের দাবিদার। তাঁর চিন্তাচেতনায় মানবাধিকারের অন্যতম দর্শন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সবসময়ই সমুজ্জ্বল ছিল।

বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিকে ঘৃণা করতেন। তিনি জানতেন, দেশের উন্নয়নের অন্যতম বাধা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজ ও মুনাফাখোররা অন্য মানুষের অধিকার হরণ করে নিজেরা মুনাফা লোটেন। তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোর ও চোরাকারবারিদের দমনে কঠোর মনোভাব পোষণ করেন। তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার মতোই দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করছেন। কার্যত বাংলাদেশের মাটি থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদককে রুখে দেয়ার এখনই সময় এবং সবার সমবেত প্রচেষ্টায় তা প্রশমিত হবে।

বঙ্গবন্ধু একজন মানবপ্রেমী মানুষ ছিলেন। মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অসামান্য দরদ। ছোট-বড়, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে তিনি ভালোবেসেছেন। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও তিনি তাঁর মানবপ্রেমের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী সেলিম (আব্দুল) ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেয়াকালে আব্দুল উল্লেখ করেন, দুজন কালো পোশাকধারী তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলি খেয়ে তিনি দরজার সামনেই পড়ে যান। পরে সিঁড়ির পাশে হেলান দিয়ে বসে থাকা অবস্থায় দেখেন, চার-পাঁচজন আর্মির লোক বঙ্গবন্ধুকে তাঁর রুম থেকে ধরে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে বলেছিলেন, ‘ওই ছেলেটা, ছোটবেলা থেকে আমাদের এখানে থাকে, একে কে গুলি করল?’ এ রকম একটা অচিন্তনীয় ভীতিকর পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধুর মন কেঁদে উঠেছিল গৃহকর্মী আব্দুলের জন্য।

বঙ্গবন্ধু সারাজীবন অন্যের অধিকার সুরক্ষা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবন, নিজের আরাম ও আয়েশের কথা ভাবেননি। অথচ বাঙালি জাতির কী দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানি হানাদাররা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাহস না করলেও এ দেশেরই একদল বিপথগামী সেনাসদস্য কল্পনাকেও হার মানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনা এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা কখনোই পূরণযোগ্য নয়।

মানবাধিকার সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর শাসনামলেই প্রণীত হয় ‘মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯’। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আইনের বিধান অনুযায়ী এর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালিত করছে।

এবছর মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য হলোÑ‘বৈষম্য ঘোচাও, সাম্য বাড়াও, মানবাধিকারের সুরক্ষা দাও (ঊছটঅখওঞণক্সজবফঁপরহম রহবয়ঁধষরঃরবং, ধফাধহপরহম যঁসধহ ৎরমযঃং)। টেকসই উন্নয়নের মূলমন্ত্রও হলো কাউকে পেছনে ফেলে নয়। কিন্তু নারী-পুরুষ, ধনী-গরিবের বৈষম্য সমাজে এখনও বিদ্যমান। নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবার সেরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেয়েদের জীবনের অধিকার, সম্পত্তির মালিকানা, সম্ভ্রম-সুরক্ষা নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কন্যাসন্তানকে এখনও অনেকেই পুত্রসন্তানের মতো সমভাবে দেখেন না। যদিও আমাদের অনেক কন্যাই এখন শিক্ষাদীক্ষা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, কর্মস্থলÑসব ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে যে কম যোগ্য নন, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। এর পরও কোনো কোনো পরিবারে এখনও কন্যাশিশুর জš§ দেয়ার সুবাদে জš§দাত্রী মাকে কতই না গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। কন্যাসন্তানের সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারের বিড়ম্বনা এবং কন্যাসন্তানের সম্ভ্রম সুরক্ষার অনিশ্চয়তা এর একটি বড় কারণ।

গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখি নারীদের ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম ঘটনার শিকার হতে। রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, এমনকি বাড়িতে পরিবারের নিকটতম স্বজনের দ্বারাও তারা লাঞ্ছিত হয়। ছয় বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধাকেও ধর্ষণের শিকার হতে হয়। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম ঘটনার বিরুদ্ধে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলেছেন, ধর্ষকের কোনো দল নেই। আইন অনুযায়ী তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে। আইন সংশোধন করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ঘটছেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধ পর্নোগ্রাফি দেখার সুযোগ থাকায় ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। এই ঘৃণ্যতম অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ তুলতে হবে; পরিবারে নারীকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা বন্ধ করা এবং গৃহকর্মে নারীর অবদানের মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি।

এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও বর্তমানে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা ও অনাচার তৈরি হয়েছে। অনেক সময় গুজবের মাধ্যমেও সমাজে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা হয়, যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য একাধারে পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার বিকাশ সাধন যেমন প্রয়োজন, তেমনি তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত আজকের যারা কিশোর-কিশোরী তাদের মধ্যেও মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে।

পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ তৈরির মাধ্যমে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নারী, পুরুষ, হিজড়া, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে নয়, সবাই মানুষ। এই মানুষ পরিচয় নিয়ে যেদিন পরিচিত হতে পারব, সেদিনই সমাজে মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং সেই লক্ষ্য নিয়েই বর্তমান কমিশন কাজ করে যাচ্ছে।

গণ-অংশীদারিত্ব ছাড়া বড় কোনো সাফল্য আসতে পারে না। অতএব আসুন, সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে সমুন্নত করার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাই। উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশ মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, এটাই প্রত্যাশা।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০