রেহেনুমা সেহেলী কবির: পৃথিবী সৃষ্টির ঊষালগ্নে মানুষের মাঝে জাত, ধর্ম ও বর্ণভেদ ছিল না। কিন্তু কালের পরিক্রমায় স্বার্থান্বেষী মানুষের আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার ফলস্বরূপ উম্মেষ ঘটে সাম্প্রদায়িকতার। সাম্প্রদায়িকতা কোনো ব্যক্তির এমন একটি মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ, যার মাধ্যমে ব্যক্তি এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য একটি সম্প্রদায় ও তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ ও ক্ষতিসাধন করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। আর এভাবেই সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে অযাচিত জাতিবিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে দিগি¦দিক। মানবসভ্যতার অভিশাপরূপে বিবেচ্য এই সাম্প্রদায়িকতা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের উন্নতির অন্তরায়, যার মূলে রয়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসের এক অদৃশ্য বলয়।
বাংলাদেশ আমাদের জš§ভূমি। জš§সূত্রে আমরা সবাই এদেশের নাগরিক। একই দেশমাতৃকার স্নেহছায়ায় লালিত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষেরই নিজ নিজ ধর্ম পালন ও সংস্কৃতিচর্চার সম-অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র যে উক্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, আমরা হিন্দু-মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। মাতৃভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে ধর্মকেন্দ্রিক বিভেদ বরাবরই অযাচিত ও অশোভনীয়। তাছাড়া অন্যের ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ কখনোই নিজ ধর্ম নিষ্ঠার পরিচায়ক হতে পারে না। বরং অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শনের মধ্য দিয়েই প্রকৃত ধর্মনিষ্ঠা প্রকাশ পায়। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ইব্রাহিম খাঁর মতে, ‘মানুষের জন্য যাহা কল্যাণকর, তাহাই ধর্ম। যে ধর্ম যাপন করতে গিয়ে মানুষের অকল্যাণ করতে হয়, তা ধর্মের কুসংস্কার মাত্র। মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়।’”
সুবিবেচনা বোধ ও মানবিকতার অভাবে আমরা আজও সাম্প্রদায়িকতার সেকেলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন শৃঙ্খল ভাঙতে পারিনি। নিজ ধর্মপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে আমরা অন্যের ধর্মকে হীন প্রতিপন্ন করতে কুণ্ঠিত হই না। যেখানে পৃথিবীর সব ধর্মের মূল কথা প্রেম, মৈত্রী, শান্তি ও সম্প্রীতি, সেখানে ধর্মকেন্দ্রিক মাত্রাতিরিক্ত অন্ধ আবেগে আপ্লুত হয়ে হীন কর্মকাণ্ড সম্পাদনের মধ্য দিয়ে এক সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয় দেওয়া মানবসমাজের এই সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে ইতিহাসই তার সাক্ষ্য বহন করে। এছাড়া বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, প্যালেস্টাইন, বসনিয়া, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশে চলমান সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতা বিশ্বশান্তি ও ঐক্য-সংহতি বিনষ্ট করছে এবং এর পাশাপাশি সেখানে মানবতার অবমাননাকর দৃশ্য আজও সমগ্র বিশ্ববাসীর মানসপটে বিরাজমান।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও রাষ্ট্রনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। এমনকি বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, সম্প্রদায় ও নৃ-গোষ্ঠীর অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নিজ নিজ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ধর্মকেন্দ্রিক সহিংসতা বাঙালি জাতির ঐক্য ও সম্প্রীতির মূলে কুঠারাঘাত করে, যা নিঃসন্দেহে ন্যক্কারজনক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী, বর্বরোচিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সঙ্গে জড়িত যেকোনো ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ধর্ম, দেশ, জাতি ও মানবতার চরম শত্রু। তাই ইতিহাসে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত আচরণের পুনরাবৃত্তি প্রতিহত করার জন্য এসব দুষ্কৃতকারীর মুখোশ উšে§াচন করার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা জরুরি। এ ব্যাপারে তরুণসমাজকে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে এক আঙিনায় পাশাপাশি বসে শিক্ষা গ্রহণ, বন্ধুত্ব স্থাপন, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এবং সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে। শৈশব থেকে এ ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ বন্ধুত্ব স্থাপনের মানসিকতা ভবিষ্যৎ প্রজš§কে সম্প্রীতির পথে পরিচালিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই আমাদের নতুন প্রজন্মকে শৈশব থেকেই অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দিতে হবে।
কোনো দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তির সমষ্টি নিয়ে গঠিত জাতির ব্যক্তিগত থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি নিশ্চিত করতে অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশ সাধন অত্যাবশ্যক। বিশ্বজনীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমেই সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব। আর এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিকশিত করার জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পরোপকারী কল্যাণব্রতী মনোভাব এবং সব ধর্মের সারবস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা রাখার পাশাপাশি ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণœ রাখতে হবে। এছাড়া সুনাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করে তোলার মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আর তাতেই সমগ্র দেশ ও জাতির প্রকৃত কল্যাণ নিহিত। পক্ষান্তরে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা মনুষ্যত্বের এক নিদারুণ অপমান। তাই এ বিষয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা না রেখে বরং নিজ নিজ অবস্থান থেকে আওয়াজ তুলতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে এই জগৎবিধ্বংসী অনাচারের বিরুদ্ধে। পুনরুদ্ধার করতে হবে হারানো মানবিকতা ও মনুষ্যত্ববোধকে। তবেই বাঙালির দীর্ঘ লালায়িত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ