রফিক মজিদ, শেরপুর : শেরপুর শহরের সজবরখিলা এলাকার হরিজনপল্লীতে প্রায় ৩০০ বছর ধরে বংশানুক্রমে বসবাস করে আসছেন হেলা ও বাসফোর সম্প্রদায়ের হরিজনরা। ভাঙাচোরা ঘিঞ্জি ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। জায়গাটি জেলা প্রশাসনের খাসখতিয়ানের। দিন দিন এখানকার লোকসংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। অবহেলিত এ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করলেও এখানে বসবাসকারী দুই শতাধিক পরিবারে আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন একটা লাগেনি।
সম্প্রতি মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে হরিজনপল্লীর বাসিন্দাদের আবাসন সংকট দূর করতে সরকারিভাবে সাত তলাবিশিষ্ট পাকা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শেরপুরসহ কয়েকটি জেলার হরিজনপল্লীতে এসব বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ এলজিইডির পক্ষ থেকে জায়গাও পরিমাপ করা হয়েছে।
শেরপুর শহরের সজবরখিলা এলাকায় অবস্থিত হরিজনপল্লীর বাসিন্দা দুই গোত্রের প্রায় ৭০ পরিবারের মধ্যে ৩৬টি পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আবাসনের বহুতল ভবন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইকাজ সম্পন্ন করে নকশাও অনুমোদন করেছিল। কিন্তু ভূমি জটিলতার কারণে বহুতল ভবন নির্মাণকাজ থমকে আছে। শেরপুর শহরের সজবরখিলা এলাকার ভূমি সরকারের খাসখতিয়ানভুক্ত। যে কারণে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাসখতিয়ানের ওই ভূমি আবাসনের জন্য ব্যবহারের উদ্যোগ না নেয়া পর্যন্ত বহুতল ভবন নির্মাণের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ভূমি জটিলতা নিরসন করে অবিলম্বে সরকারি বহুতল ববন নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন হরিজনপল্লীর বাসিন্দাসহ নাগরিক সংগঠনের নেতারা।
হরিজনপল্লীর সদস্যরা জানান, আমাদের পূর্ব বংশ প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে এ অঞ্চলে আসে স্থানীয়দের পরিচ্ছন্নতা ও পয়োনিষ্কাশনের কাজে। এরপর এক সময় প্রায় দেড়শ বছর আগে ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শেরপুর মিউনিসিপ্যাল; পরবর্তীতে শেরপুর পৌরসভা। ওই সময় থেকেই তাদের পূর্বপুরুষরা শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়ির মল, রাস্তাঘাট ও ড্রেন পরিষ্কারের কাজ করে আসছে। বর্তমানে উন্নত হয়েছে পৌরসভা, উন্নত জীবনযাপনে পৌরবাসী ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাও উন্নয়ন হয়েছে। ফলে পূর্বের মতো প্রয়োজন হয় না মল পরিষ্কারের। তবে ড্রেন ও শহর ঝাড়– দেয়ার কাজ করতে হয় তাদের। পৌরসভা ও পৌরবাসীর এত উন্নয়ন হলেও হরিজনদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি। বেঁচে থাকার জন্য এক খ- জমি এবং ন্যূনতম মাথা গোঁজার এক টুকরো টিনের ছাউনিও তাদের কপালে জোটেনি। পৌরসভা থেকে প্রাপ্ত জেলা প্রশাসনের খাসক্ষতিয়ানের প্রায় দের একর জমির ওপর বস্তিতে ৬-৭ ফুট ঘরের ভেতর ছেলেমেয়ে নিয়ে ৬-৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে রাতে ঘুমোতে হয়। পুরো পল্লীবাসীর কমন বাথরুম রয়েছে মাত্র কয়েকটি। এভাবেই হরিজনপল্লীর দুই গোত্রের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ পরিবারের ৩ শতাধিক মানুষ বসবাস করে আসছে। পল্লীর শিশুদের জন্য নেই কোনো খেলার মাঠ বা স্কুল। ফলে বেশিরভাগ শিশুই শিক্ষার আলো দেখছে না। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও একই। লেখাপড়া ও চাকরির ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার তারা।
গত ৬ জুলাই হরিজনপল্লী পরিদর্শন করে তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন নাগরিক প্ল্যাটফরম জনউদ্যোগ, শেরপুর কমিটির সদস্যরা। এ সময় স্থানীয় মিডিয়াকর্মীরাও তাদের সাথে ছিলেন। পরে হরিজনপল্লীর ভূমি-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে সরকারি বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
এ সময় জনউদ্যোগ কমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ, সদস্য সচিব হাকিম বাবুল, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শিব শংকর কারুয়া, প্রেস ক্লাব সভাপতি শরিফুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মেরাজ উদ্দিন, শিক্ষক আবু হান্নান, নারী উদ্যোক্তা আইরীন পারভীন, বিতার্কিক এসএম ইমতিয়াজ চৌধুরী, শুভংকর সাহা, হরিজন নেতা নন্দ কিশোর, বিমল বাসফোর, শামল বাসফোর, মুক্তা, মিলন, রাজু হরিজন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার কার্যালয়ের বাইরে থাকায় নেতারা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মোক্তাদিরুল আহমেদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে হরিজনদের উন্নয়নে সম্ভব সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন।

Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 3:50 am
মানবেতর জীবনযাপন করছেন শেরপুর হরিজনপল্লীর বাসিন্দারা
সারা বাংলা ♦ প্রকাশ: