নাজমুল হুসাইন: দেশে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। কিন্তু এর মধ্যে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানসিক রোগে আক্রান্তের হার সব থেকে বেশি। দেশে এ ধরনের রোগে ভুগছে এক কোটি ৩২ লাখের বেশি মানুষ। যা জনসংখ্যার শতকরা প্রায় সাড়ে আট শতাংশ। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এসব রোগীর সংখ্যায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ বাংলাদেশ।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ডিপ্রেশন অ্যান্ড আদার কমন মেন্টাল ডিজঅর্ডার্স: গ্লোবাল হেলথ ইস্টিমেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসছে এমন চিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য সমন্বিত করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩২ কোটি মানুষ বিষাদগ্রস্ততায় ভুগছে। আর উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছে প্রায় ২৬ কোটি। পুরুষের তুলনায় এসব মানসিক রোগে নারীর আক্রান্তের হার বেশি। এসব রোগের একেবারে শেষ স্তরে গিয়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৬৩ লাখ ৯১ হাজারের বেশি মানুষ বিষাদগ্রস্ততায় ভুগছে। আর উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছে ৬৯ লাখ মানুষ। দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা থেকে তৈরি এ দুই রোগে এক কোটি ৩২ লাখ মানুষ আক্রান্ত। এটি মোট জনসংখ্যার সাড়ে আট শতাংশ। জনসংখ্যার চার দশমিক এক শতাংশ বিষাদগ্রস্ততা ও উদ্বেগজনিত সমস্যায় চার দশমিক চার শতাংশ রোগী বাংলাদেশে রয়েছেন।
প্রতিবেদনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে এই দুই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে আট শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার ভারতে এ দুই রোগে আক্রান্ত সাড়ে সাত শতাংশ, পাকিস্তানে সাত দশমিক সাত, আফগানিস্তানে সাত দশমিক তিন, ভুটানে সাত দশমিক ৯, মালদ্বীপে সাত, নেপালে ছয় দশমিক আট ও শ্রীলঙ্কায় সাড়ে সাত শতাংশ মানুষ রয়েছে।
বাংলাদেশে এ দুই ধরনের রোগে আক্রান্তের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও সামগ্রিকভাবে মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই কোটির বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত যৌথ এক গবেষণায় এ তথ্য জানা যায়। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক রোগী রয়েছেন ১৬ শতাংশ। তবে শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ হার আরও বেশি। ১৮ শতাংশ অপ্রাপ্ত বয়স্ক বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় রয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, আর্থসামাজিক বাস্তবতায় অনেকে মানসিক সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছেন। পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা, বঞ্চনা, অবহেলা এবং বৈষম্যের কারণে অনেকে মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। এছাড়া শারীরিক সমস্যা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, জিন বা বংশগতি ও অনেকে নেশাগ্রস্ততায় মানসিক রোগে ভোগেন।
অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রেও এসব বিষয় কাজ করে। তবে ছোট বিষয়গুলোও ছোটদের মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। যেমন পরীক্ষা বা লেখাপড়ায় খারাপ করা, অতিরিক্ত গেমস, টেলিভিশন দেখা প্রভৃতি। অপরদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, রোগী বাড়লেও চিকিৎসার ক্ষেত্রে মানসিক রোগীরা পারিবারিক, সামাজিক অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসায় মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও সমস্যা উত্তরণের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
এসব বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সামাজিক সচেতনতার অভাবে মানসিক রোগে আক্রান্ত হাজার হাজার রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। অনেক পরিবার শিশুর রোগ শনাক্ত করতে পারে না। অনেকে আবার চিকিৎসা নিতে এলেও নাম-পরিচয় গোপন রাখেন। এ কারণে দেশে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ঠিক কত, তা নিশ্চিত করা কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও দুই-তৃতীয়াংশ মানসিক রোগী চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বে ৮০ কোটি মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে বিশ্বে ২০০ কোটি মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হবে।
কীভাবে মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়Ñএমন প্রশ্নের জবাবে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান খান বলেন, ‘শরীরে কোনো রোগ হলে তা নিবারণে যতœ নিতে হয়; সুষম খাদ্য খেতে হয়। একইভাবে মনের সুস্থতার জন্যও নিয়মিত মনের যতœ নিতে হয়। ব্যায়াম মনের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাস পরিবর্তনে সহায়ক হয়।’
তিনি বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক রোগÑএ দুটি বিষয়কে অনেকে এক করে ফেলেন। মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা হচ্ছে মনের কোনো অস্বাভাবিক অবস্থা। এ সমস্যা দূর করতে কখনও ওষুধ দিয়ে এবং কখনও সাইকোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। কিন্তু মানসিক রোগ নেই এমন ব্যক্তিরও মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা উচিত, যাতে সে মানসিক রোগ বা সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে পারে।’
ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর মানসিক রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান রতন বলেন, ‘তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের সমস্যায় মস্তিষ্কের রাসায়নিকের তারতম্য দেখা যায়, যে কারণে ওষুধের প্রয়োজন হয়। মৃদু ও মাঝারি ধরনের বিষণœতায় সাইকোথেরাপি বেশ কার্যকর। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে ও মনোবিজ্ঞানীর সহযোগিতায় এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
Add Comment