Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:19 am

মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ড ও বিপন্ন মানবতা

চোর সন্দেহে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্দয় নির্যাতনের ইতিহাস গড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় মেধাবী শিক্ষার্থী। ফজলুল হক মুসলিম হলের কয়েকজন ছাত্র গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) তোফাজ্জল নামের এক যুবককে চোর ভেবে অত্যাচার করতে শুরু করে। অমানুষিক নির্যাতন তোফাজ্জলকে আজীবনের জন্য পরপারের বাসিন্দা করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই অত্যাচারের ভিডিও দেখলে সংবেদনশীল মানব হƒদয়ে রক্তক্ষরণ হবেই।

জানা যায়, তোফাজ্জলের জš§স্থান বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অস্থিরতায় নিমজ্জিত ছিল তোফাজ্জল। ঢাবির মেধাবীরা একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের স্বরূপ নির্ণয়ে ব্যর্থ। আসলেই কি একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের স্বরূপ নির্ণয়ে ব্যর্থ ঢাবি শিক্ষার্থী পরিচয়ধারী ওই খুনিরা নাকি নিজেরাই মানসিক ভারসাম্যহীন? নাকি নির্যাতিতের আর্তনাদে কেবলই পৈশাচিক আনন্দ প্রাপ্তি? মানব সভ্যতার প্রথম থেকেই সম-অধিকারকে তাচ্ছিল্য করেছে মানুষ। মানুষের শক্তিশালী দল তুলনামূলক কম শক্তিশালী দলকে বঞ্চিত করেছে।

একসময় শুধু দেশ দখলের জন্য যুদ্ধ হতো। সভ্যতার শিক্ষাই হলো মানবতা। সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে মানবতারও উন্নতি হওয়া উচিত। মানবতার উন্নতি হলে মানুষের ভেতরে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ভালোবাসা ইত্যাদিরও মানোন্নয়ন হয়। কালের নিয়মে আরও উৎকৃষ্ট, উন্নততর মানবতার দিকে ধাবমান হয়। আবার মূল্যবোধের অবক্ষয় হলে মানবতারও অবক্ষয় হয়। মানব সভ্যতা ও মানবতা অসীম সম্ভাবনাময়। বিপন্ন মানবতার বিচিত্র দৃশ্য প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত একইভাবে বিরাজমান। মানুষ শিক্ষিত হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলতে শিখেছে কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও মানব মনের সহিংসতা, রক্তপাত, হানাহানি, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা দূর হয়নি। শুধু শান্তিতে বেঁচে থাকতে পৃথিবীতে মানুষের উদ্যোগ-উদ্যমের শেষ নেই। কিন্তু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার দুর্নিবার আকাক্সক্ষা আজ কেন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে? শান্তির বাতাবরণ নষ্ট করে কেন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে অশান্তির দাবানল?

২০১৯ সালে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে পিটিয়ে হত্যা করেছিল বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। আবরারের সেই করুণ মৃত্যুতে ভেসে উঠেছিল ছাত্র রাজনীতির পৈশাচিকতা। রাষ্ট্র ক্ষমতার পালাবদলের পর বস্তুত ক্যাম্পাসে দৃশ্যমান কোনো ছাত্র রাজনীতি নেই। তারপরও একই ঘটনার রক্তাক্ত পুনরাবৃত্তি দেশবাসীকে হতাশ করেছে। তোফাজ্জলের খুনিরা আবারও প্রমাণ করে দিল মানুষের ঘরে জš§ নিলেই মানব হওয়া যায় না। মানব হওয়ার জন্য মানবিক গুণাবলির চর্চা অপরিহার্য। জীবনে মানবিক গুণাবলি অর্জন করেই মানুষ থেকে মানব হতে হয়।

তোফাজ্জলকে নির্যাতনের সময় একটিবারের জন্যও ঘাতকরা মনে করেনি সে মানুষ। যে ছাত্র সমাজের নেতৃত্ব সহজেই গ্রহণ করে নিয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ সেই ছাত্র সমাজের একি চিত্র? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানা যায় তোফাজ্জল হোসেন চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে। তিনি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তার মা, বাবা ও বড় ভাই মারা যান। ছেড়ে যায় প্রেমিকাও। সব মিলিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে তোফাজ্জল। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতেই হয়তো ঢাবি ক্যাম্পাসে গিয়েছিল তোফাজ্জল। নির্যাতন করে হত্যার আগে তোফাজ্জল হোসেনকে ভাত খেতে দিয়েছিল খুনি শিক্ষার্থীরা। সে বুঝতেই পারেনি এই ভাতই তার জীবনের শেষ খাওয়া। প্রশংসাও করেছিল সেই খাবারের। খাবার খাওয়ানোর পরপরই চলে পুনঃপুন নির্যাতন। এ যেন মানবতার এক মহাপরাজয়। মানবজাতির ইতিহাসই কী তাহলে মানবতা পরাজয়ের ইতিহাস। মানবজাতির পরাজয় কী তাহলে মানবতা-সংহারক বিকৃত চিন্তাচেতনার মধ্যে নিহিত? প্রশ্ন থেকেই যায় উত্তর জানা নেই।