মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন জরুরি

আবু সালেহ মোহাম্মদ মুসা :বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। শাশ্বত এ বাণী এখন যেন নীরবে নিভৃতে কাঁদে। ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা মায়ের হাতে নির্মমভাবে নিহত হচ্ছে একের পর এক। একই ধরনের বীভৎস অমানুষিক নির্যাতনের খবরে আকাশ-বাতাস আজ ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে। অবিশ্বাস্য ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে সত্য হিসেবে বার বার ফুটে উঠছে। একি আজব, অবর্ণনীয়, অকল্পনীয়, দুঃসহ ঘটনা আমাদের দেখতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা কি মানুষ! আদৌ কি মানুষ! তাহলে কি হুঁশবিহীন মানুষ নামের প্রেতাত্মা আমাদের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে মায়া-মমতাহীন করে জš§ দিয়েছে, প্রশ্নের কোনো শেষ নেই, আর উত্তরও জানা নেই। আমাদের নতুন করে সূক্ষ্মভাবে ভেবে দেখতে হবে বিপথগামী সন্তানদের বিষয়টিও।

প্রাণিকুলের সর্বত্রই মায়ের কোল শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এ বিশ্বাস আজ হারিয়ে আমরা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য। কীসের শিক্ষায় আমরা শিক্ষিত, কীসের কারণে আমরা নিজেদের শিক্ষিত ভাবছি, আমাদের মনুষ্যত্ব কোথায়, জবাব দিতে পারা যাবে না। বিবেক-বুদ্ধিহীন বলেই আমরা পশু নাম দিয়েছি যেসব প্রাণীর তাদের কখনও নিজের সন্তানকে হত্যা করতে শোনা যায়নি। অথচ মা সন্তানকে হত্যা করছেÑএকের পর এক, শিক্ষিত ছেলেরা কেন ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার ফাঁদে পা দিচ্ছে? একি কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক আচরণ, তাহলে বলতে হবে মানুষ পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণীতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

আজ বহুদিন ধরে পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ছে বীভৎস ঘটনা। দিনে দিনে শুনতে শুনতে চোখের পানি শেষ। সময় এসেছে এর প্রতিরোধে সুচিন্তিত সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা গ্রহণের। মানসিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এবং প্রয়োজনে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণের। মনের গহিন কোণে যে বিষয়টি বাসা বাঁধতে শুরু করেছে তাকে সমূলে উৎপাটনের জন্য এগিয়ে আসার। শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে অবচেতন মনে যে ছায়া আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছেÑতাকে সারিয়ে তুলতে না পারলে যে বহিঃপ্রকাশ, তা হবে অকল্পনীয়। হƒদয়ের টানে যে মায়ের মন দোলে না, তাকে অসুস্থ মনের গতি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা ভিন্ন; অন্য কিছু বলা যায় না। শিক্ষিত সন্তানেরাই বা কীভাবে পিতা-মাতাকে ভুলে বিপথগামী হয়ে নিজেদের জীবন ধ্বংস করছে, মা-বাবাকে করছে সন্তানহারা?

বিশ্বে বহু আগে থেকেই মনোবিজ্ঞান বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়ে আসছে। ব্যবহারিক জীবনে তার বহুবিধ প্রয়োগও ক্রমাগতভাবে চলে আসছে। আমাদের দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে থাকা এ বিষয়টির অতি সীমিত প্রয়োগে হয়েছে। ফলে এ বিষয়ে যারা এ যাবৎ পড়াশোনা করেছে তারা জীবিকার তাগিদে নিজেদের অন্য পেশায় নিয়োজিত করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে সাইকোলজিক্যাল বিষয়ের কোনো উন্নয়ন বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। মাঝে মধ্যে স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের কোনো উন্নয়নই হয়নি। আজ যে হারে দেশের মধ্যে মানসিক সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তার পরিণতি যে ভয়ঙ্কর রূপ নেবে না একথা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়। তাই দ্রুত বিবেচনায় নিয়ে দেশের সব স্কুল-কলেজে অন্তত দু-এক জন করে সাইকোলজিস্ট নিয়োগের পাশাপাশি পাঠ্যসূচিতে নৈতিক অবক্ষয় রোধে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার প্রয়োজন। মাসে অন্তত দু’বার সব ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতিতে যাতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত জরুরি। শুধু স্কুল-কলেজে নয়; সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর সচেতনতার উন্নয়নে জনবহুল স্থান যেমন মসজিদ, মন্দিরে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে প্রচারণা চালানো যায় তা ভাবতে হবে।

সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিবসহ বহু উচ্চ পর্যায়ের কর্মচারীদেরও আত্মহত্যার খবর আজ শোনা যায়। ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’-এ বাণী যারা এক সময় প্রচার করেছে তাদের মতো উচ্চ শিক্ষিত কিছু মানুষ যখন এ পথ বেছে নেয়; তখন বিষয়টির আরও গভীরে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। আরও চিন্তিত সুদূরপ্রসারী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আমাদের সঠিক পথ দেখায়। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের অসচ্ছলতা, ব্যস্ততা, কর্মচঞ্চলতা, রোগ-ব্যাধি, টেনশন ইত্যাদি সমস্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। চোখে দেখা না গেলেও দিনে দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিরই ইঙ্গিত দেয়। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে কোনো সরকারই উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে যে লাউ সেই কদু, বাস্তবে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন বলে কিছু নেই। বিদেশে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে সাইকোলজিস্টরা নিয়োজিত আছে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে। সরকারের উদ্যোগে প্রয়োজন মতো পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে সেসব জাতি উন্নত মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী। আমরা আশা করি, আমাদের সরকার এ বিষয়ে অচিরেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বর্তমান সরকার আমাদের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা, জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপে আজ স্বাস্থ্যসেবা প্রশংসনীয় সফলতা পেয়েছে। এখন সময় এসেছে স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি বিশেষভাবে জনগণের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করার। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করা সাইকোলজিস্টরা আর যাতে ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত না হয় সে জন্য তাদের যথাযথ স্থানে চাকরির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞ সাইকোলোজিস্টদের সমন্বয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জাতির এ ক্রান্তিকালে কী কী বাস্তবমুখী জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তা ভাবতে হবে। একটি বিশদ পরিকল্পনা করে যত দ্রুত সম্ভব তার বাস্তবায়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশু হত্যা, নারী নির্যাতন, স্বামী-স্ত্রীর অযথা ছাড়াছাড়ি, আত্মহত্যা, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা, মানসিক বৈকল্যসহ সর্বপ্রকার অসামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে সবাইকে ফিরিয়ে আনতে পারলেই সমাজে শান্তি বিরাজ করবে। আমাদের বুঝতে হবে আজ যারা এগুলো করছে তারা মানসিকভাবে সুস্থ নয়, যেকোনোভাবেই হোক তাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে, আমদের সবার স্বার্থে, বাংলাদেশের উন্নয়নে তথা বিশ্বের সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠায়।

মুক্ত লেখক

শ্যামলী, ঢাকা

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০