মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময় এখনই

লুৎফর রহমান: প্রাকৃতিক দুর্যোগের আধার বলা হয় সোনার বাংলাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এদেশের নিত্যসঙ্গী। দেশের প্রতিটি অঞ্চল কোনো না কোনো সময় বিভিন্ন রকম দুর্যোগের সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে, তার মাঝে অন্যতম বন্যা। নদীবহুল এদেশে বন্যা মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছর ব্যাপক জোয়ার ও ভারী বৃষ্টিতে নদীর জল দুকূল ভাসিয়ে বন্যা সৃষ্টি করে। এর ফলে ব্যাপক ক্ষতি হয় মানবকুল, পশুপাখি, প্রাণী ও জীবজগতের। সর্বোপরি মানবজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়, বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ছোট-বড় মিলিয়ে দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, পূর্ব, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বেশ কয়েকবার বন্যা হয়েছে। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখছে সিলেটবাসী।

ইরি মৌসুমের শুরু থেকে লাগাতার বৃষ্টি ও ভারী বর্ষণে ফসল পর্যন্ত ঘরে তুলতে পারেনি সিলেটের মানুষ। এতেই শেষ কোথায়? এর সঙ্গে আবারও নতুন করে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, সিলেটে ভারী বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় অনেক অঞ্চল ডুবে যায়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার ফলে ফারাক্কা বাঁধের বেশকিছু বাঁধ ছেড়ে দেয় ভারত, যার ফলাফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে শুরু হয় কল্পনাতীত বন্যা। এছাড়া যমুনা, পদ্মা ও মেঘনাÑসব নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়তে থাকায় অন্তত ১৫ জেলার নি¤œাঞ্চল বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের এই জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। উজানে ভারী বর্ষণ চলতে থাকায় দেশের বিভিন্ন জেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যার বিস্তার ঘটছে।

পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট উত্তর-মধ্যাঞ্চলের জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা; মধ্যাঞ্চলের মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরিয়তপুর, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে ব্যাপক হারে। নি¤œাঞ্চলে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির চিত্র ভয়াবহ এবং এর খবর সবার কাছে হেডলাইন হিসেবে এলেও ঠিক একই রকম দুরবস্থা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, শেরপুর, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহের, যেখানে প্রশাসন কিংবা বিত্তবানদের সুনজর নেই বললেই চলে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর অবস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।

প্রতিবেদনে নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি বাড়ছে, যা কতদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে, তা বলা মুশকিল। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর পানির অতি বৃদ্ধির ফলে প্লাবিত হয়েছে সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সবকটি জেলাসহ রংপুরের পাঁচটি জেলা এবং তলিয়ে যাওয়া সবকটি জেলা সীমান্তবর্তী। বন্যার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। আর নদীভাঙনের ফলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে শত শত একর ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, পশুপাখি ও  জীবজগতের বৈচিত্র্য।

তাই সব সহায়-সম্পদ হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে অনেক মানুষ। বন্যাকবলিত হয়ে মানুষ হারিয়েছে হাজার হাজার বসতবাড়ি, লাখ লাখ টন হেক্টর জমির সবজি, মৎস্য খামার ও পোলট্রি খামার। গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য জীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। বন্যাকবলিত হয়ে গোয়ালের গবাদিপশু, ফসল সবই ক্ষতিগ্রস্ত। ধ্বংস হয়েছে কয়েকশ পোলট্রি খামার, ভেসে আসছে হাজারো হাঁস-মুরগি, অনেক মানুষের তৈরি মাটির ঘর এবং হাজার একর ফসল। মাছের খামার ডুবে যাওয়ার কারণে ভেসে গেছে শতকোটি টাকার মাছ, পানিতে ভেসে আসছে গবাদিপশু। রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি ও স্কুলের মাঠÑসবই ডুবে গেছে পানিতে। মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির ও গির্জাÑসব স্থানেই পানি। ঘরে পানি, বাইরে পানি, রাস্তায় পানি, এমনকি অনেক অঞ্চলে দাঁড়ানোর জন্য নেই শুকনো একটু জায়গা। বসা, খাওয়া ও ঘুমানোর জন্যও কোথাও একটু জায়গা নেই। এতদঞ্চলের মানুষের জীবন আজ বড়ই কষ্টে পরিপূর্ণ। মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুদের কষ্ট আরও বেশি, তারা আরও বেশি অসহায়। সবচেয়ে কষ্টের দৃশ্য সিলেটে ভাসমান মৃত শিশুর লাশ। চারদিকে শুধু মানবতার হাহাকার।

বন্যার পানির কারণে বন্ধ আছে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা। বন্যায় পতিত এই মানুষগুলোর জন্য কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দরকার, যেমন খাদ্য, বস্ত্র, নিরাপদ পানি, ওষুধ ও থাকার জন্য স্বাস্থ্যকর একটা পরিবেশ। খাবার পানির বড়ই অভাব, কারণ গভীর নলকূপগুলো সব পানির নিচে, আর পুকুরগুলো ময়লা ও দূষিত পানিতে ভরপুর। আর রান্না করার কোনো ব্যবস্থা ও সুযোগ নেই, তাই তাদের শুকনো খাবার হিসেবে চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট, রুটি প্রভৃতি খেয়ে জীবন চালাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয় নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নেই; আর যা আছে তা একেবারে নগণ্য। তাই মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য গবাদিপশু নিয়ে উঁচু রাস্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয় কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে অবস্থান করছে। এককথায় ত্রাণের সাহায্যের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে জীবন।

তাই প্রতিবছরের মতো এবারও এসব দুর্গত ভাইদের রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। সরকার প্রতিবছর ত্রাণসামগ্রী যথাসম্ভব পাঠানোর চেষ্টা করে, তবে এবার এখনও যথাযথভাবে সব বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রীর সাহায্য পৌঁছেনি। আর যা পৌঁছেছে তা একেবারে নগণ্য, কারণ জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ বন্যায় কবলিত। প্রতিবছর সরকার কর্তৃক যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়, তা জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্ত নয়। তবে এটাও সত্য, বন্যাকবলিত এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা সরকারের একার পক্ষে অসম্ভব। কারণ গত দুই বছর থেকে করোনা নামক অশুভ শক্তির হাতে বন্দি সারাদেশ ও বিশ্ব। কভিড মহামারি, ডেঙ্গু রোগীর সেবা, টিকা ও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করতে একপ্রকার হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এ অবস্থায়  বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এতে সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় অনেক মানুষ তাদের সামর্থ্য অনুপাতে পর্যাপ্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। তবে সিলেটের মতো বন্যাকবলিত বাকি অঞ্চলগুলোর দিকেও সরকারসহ সবাইকে নজর দিতে হবে। বন্যাকবলিত হয়ে যে ক্ষতি হয়েছে, তা বর্ণনাতীত। এসব ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। এসব দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং বন্যার পানি নেমে গেলেও এসব মানুষকে অনেক দিন সেই কষ্ট সহ্য করতে হয়। কারণ তখন মানুষ বিভিন্ন প্রকার পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। বন্যার পর বিশুদ্ধ পানির অভাব প্রকট রূপ ধারণ করে। ফলে ডাইরিয়া, কলেরা, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগের প্রভাব মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সারাদেশের সব সামর্থ্যবান মানুষ মানবতার সেবাই এগিয়ে এলে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা কঠিন ও অসম্ভব নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব দুর্গত মানুষ আবারও সহজেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সামর্থ্য অনুযায়ী দুর্গত মানুষের কাছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও প্রয়োজনীয় ওষুধ পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা বন্যার হারিয়েছে ঘর, তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে হবে। যাদের ফসল নষ্ট হয়েছে, তাদের নতুন করে কৃষিকাজের জন্য সহায়তা করতে হবে। সরকার সহজ শর্তে পর্যাপ্ত ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে পারে।

ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও সামর্থ্যবান মানুষদের আজ দুর্গত মানুষের জন্য অনেক কিছু করার আছে। সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করলে খুব সহজেই গড়ে উঠবে বড় তহবিল। সবার সহযোগিতায় সর্বহারা মানুষ আবারও স্বাভাবিক স্বস্তির জীবনে ফিরে আসবে।

শিক্ষার্থী

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০