জুবায়েদ মোস্তফা: প্রতিটি মানুষের সঙ্গে পরিবেশের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যে যখন যেই পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশের সবকিছু একজন দক্ষ কারিগরের মতো আয়ত্ত করে নেয়। ঘড়ির কাঁটার সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। পরিবেশের স্পষ্ট ভূমিকার কারণে মানুষ হয়ে ওঠে নম্রতা, ভদ্রতা, শিষ্টাচারের মূর্ত প্রতীক। অসাধারণ বাচনভঙ্গি, নিখুঁত চলন মানুষের হƒদয়ে আঁকড়ে থাকে। আবার পরিবেশের বৈরিতার কারণে কেউ কেউ জড়িয়ে যায় নেশা নামক মরণ থাবায়। নিজেকে তিলে তিলে শেষ করার পাশাপাশি একটা সাজানো পরিবারের ধ্বংস ডেকে আনে; যা জীবনকে বিপন্ন করে তোলে।
একটা সুন্দর পরিবেশ মানুষকে উপহার দিতে পারে নবজীবন। পেতে পারে এগিয়ে যাওয়ার নব উদ্যম, আশার বাতি হয়ে শক্তি আর সাহস সঞ্চার করতে পারে অপ্রতিরোধ্যভাবে, প্রত্যাশার পারদে পরিপূর্ণ হতে পারে জীবন। একটা অনুকূল পরিবেশ জীবনকে অধিকতর সুন্দর ও সাবলীলভাবে রাঙাতে শেখায়, নতুন নতুন অমীয় স্বপ্ন টানে পল্লবিত করে মানুষকে। পরিবেশজুড়ে বিষাক্ততার ছড়াছড়ি, এর সাথে দারুণ রসায়ন গড়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে আছে অনেকে। পরের সাফল্যে বুকে ঈর্ষার আগুন জ্বলা, নিশ্চিত জয়যাত্রা থামানোর অপচেষ্টা কিংবা পেছন থেকে শুকুনের মতো খামচে ধরা নতুন কোনো সংযোজন নয়। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোতে। কেউ ভালো কিছু করার ফলে যেন অন্যরাও ভালো কাজ সাধন করতে দুঃসাহসী যাত্রী হয়ে ওঠে, কাজের প্রতি যেন তীব্র স্পৃহা সৃষ্টি হয়।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে শুধু ২০১৫ সালে শুধু বায়ুদূষণের কবলে ২ লাখ ৩৪ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। যার সিংহ ভাগ ছিল শহরাঞ্চলে বসবাস করা মানুষ। শহরাঞ্চলে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৮০ হাজার, রাজধানী ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন ১৮ হাজার মানুষ। (৮ জুন ২০১৯ সূত্র: ডেইলি স্টার অনলাইন)। বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। শিল্প কারখানাগুলো অপরিকল্পিতভাবে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ফেলছে। ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে খাল ও নদীসহ অন্যান্য জলাশয়ের পানিও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। ৭১৯টি তৈরি পোশাকশিল্পের ওয়াশিং ও ডাইং কারখানার বর্জ্য দূষণের অন্যতম উৎস। এক টন কাপড় উৎপাদন করতে নদীতে বর্জ্য যাচ্ছে ২০০ টন। ইস্পাত কারখানাগুলো থেকে ১ লাখ কোটি লিটার এবং কাগজ কারখানাগুলো থেকে ৪৫ হাজার কোটি লিটার দূষিত বর্জ্য পানিতে মেশে।
পরিবেশ সুরক্ষায় নিয়ামক হিসেবে গণ্য হওয়া উপাদান বা পরিবেশের মূল উপাদান মাটি, পানি, বায়ু এবং প্রাণিকুল বা বনভূমি রক্ষায় আমরা কী ধরনের ভূমিকা পালন করছি কিংবা কতটা সচেতন তা খতিয়ে দেখা অতীব জরুরি। পরিবেশ রক্ষায় উদাসীন হলে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। পরিবেশ দূষণ রোধ করতে বাধ্য হলে বা পরিবেশ ঠিক না রাখতে পারলে মানুষের সবকিছু এমনকি আবাসভূমিও একদিন পশুপাখির অভয়ারণ্য হয়ে যাবে।
কয়েক শত বছর মাটি বা পানিতে থাকা সত্ত্বেও নষ্ট হয় না কিংবা পচে না প্লাস্টিক, এটি অনবায়নযোগ্য, জলাবদ্ধতা ও মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করার অন্যতম কারণ, জলজ ও সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
প্রতিদিন সারাবিশ্বে যে ৩৬ লাখ টন কঠিন বর্জ্য ফেলা হয়, বলাবাহুল্য যে যার প্রায় ১০ শতাংশ এই সর্বনাশা প্লাস্টিক। প্রতি বছর সাগরের কোলে ঠাঁই নেয় প্রায় এক কোটি টন প্লাস্টিক। এই বিপুল প্রবাহ যদি এখনই রোধ করা যায়, তবুও এটি সমুদ্রে প্রচুর পরিমাণে রয়ে যাবে। প্লাস্টিক নিয়ে ভাবনার সঠিক সময় এখন। প্লাস্টিক দূষণ রোধ করে পরিবেশের নব প্রাণ দেয়ার গুরুদায়িত্ব সচেতন মানুষের কাঁধে।
প্রায় সময় লক্ষ্য করা যায়, বিলাসিতা কিংবা অতি উৎসাহী আচরণের নির্মম শিকার হয় সুন্দর পরিবেশ। কিছু খেয়ে পুরোপুরি শেষ না করেই যেখানে সেখানে ফেলে দেয়, যা সুন্দর পরিবেশ বাস্তবায়ন হুমকিস্বরূপ। পরিবেশের সৌন্দর্যবর্ধনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি দূষণ রোধে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ও বিশেষ বিশেষ জায়গায় ডাস্টবিন নির্মাণ করা যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। শুধু এখানেই সমাপ্তি রেখা টানা যথেষ্ট নয়, সবাইকে ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলার সুন্দর চর্চা করতে হবে। ব্যস্ত সড়কের মোড়ে কখনও দুর্গন্ধে প্রাণ যায় যায় অবস্থা হয়, এতে কেউ কেউ অসুস্থ ও হয়ে পড়ে এবং যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা নির্মাণ করতে হবে, এতে পরিবেশের লাবণ্য হারাবে না।
গাছ মানুষের পরম বন্ধু, যে কোনো প্রকার স্বার্থসিদ্ধির তোয়াক্কা না করেই উপকার করে। গাছ কোনো প্রকার স্বার্থ ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় উপকরণ অক্সিজেন সরবরাহ করে। অক্সিজেন ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। এ মহামূল্যবান অক্সিজেন গাছ ত্যাগ করে আর মানুষ তা বিনামূল্যে গ্রহণ করে। অপরদিকে কার্বন ডাইঅক্সাইড মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। কার্বন ডাইঅক্সাইড মানুষের জীবনকে করে তুলে বিভীষিকাময়। মানুষ প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে নিঃশ্বাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। এ ক্ষতিকারক কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে মানুষকে চরমভাবে উপকৃত করে গাছ।
মানুষ প্রত্যেক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বৃক্ষের ওপর নির্ভরশীল। তবুও শিল্পায়ন ও নগরায়ণের যুগে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়। কখনও কখনও তো কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া গাছ কেটে বন উজাড় করা হয়। এতে পরিবেশ ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না।
বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বেশি হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, কারণ এই গ্যাস তাপ শোষণ করতে সক্ষম। যাকে আমরা বলে থাকি গ্রিন হাউস ইফেক্ট।
বৃক্ষ বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে গ্রিন হাউস ইফেক্টের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। অপরদিকে বাতাসে অক্সিজেন যোগ করে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাত বজায় রাখতে সাহায্য করে। এভাবে বৃক্ষ বায়ুদূষণ কম করে বাতাস বিশুদ্ধ রাখে। বৃক্ষ বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে।
সর্বোপরি বৃক্ষ মানুষকে নানাভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া সত্ত্বেও মানুষ কি বৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়?
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য উচিত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নেয়া। পাশাপাশি বেশি বেশি বৃক্ষরোপণে মনোনিবেশ করা। বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসা জš§ালে মানুষের বেঁচে থাকা আর সহজ হবে, জীবন হবে অধিকতর সুন্দর।
সর্বোপরি, পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশকে বসবাস উপযোগী রাখতে সবার অংশগ্রহণ জরুরি।
শিক্ষার্থী
লোকপ্রশাসন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়