মাফিয়ানির্ভর স্বর্ণ খাতে সরকারের দ্বৈতনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের স্বর্ণ খাত মাফিয়ানির্ভর আর জবাবদিহি ছাড়া চলছে।  দেশে বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন স্বর্ণ আমদানি হয়, যার প্রায় সবটাই চোরাচালানের মাধ্যমে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যবহৃত হচ্ছে স্বর্ণ চোরাচালানের একটি ট্রানজিট এলাকা হিসেবে। অথচ একটি সম্ভাবনাময় স্থানীয় অলংকার বাজার রয়েছে, প্রায় লক্ষাধিক জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশে। এ অবস্থায় স্থানীয় বাজারকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। এ পরিপ্রেক্ষিতে চোরাচালান বন্ধ করে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু সরকার এক্ষেত্রে দ্বৈত নীতি অনুসরণ করছে।

একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশকালে গতকাল রোববার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কর্মকর্তারা এসব কথা বলেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ও উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

‘বাংলাদেশে স্বর্ণ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে পটভূমি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি সুষ্ঠু স্বর্ণ আমদানি-নীতির অনুপস্থিতিতে এবং সার্বিকভাবে দেশের স্বর্ণ খাতের ওপর সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অভাবে স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মান এবং স্বর্ণবাজার ব্যবসায়ীদের দ্বারা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অবৈধভাবে দেশের বাইরে থেকে আসা স্বর্ণালংকার বাংলাদেশের স্বর্ণবাজার ক্রমেই দখল করে ফেলেছে। স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মান যাচাই, ক্রেতা ও বিক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণ ও স্বর্ণশিল্পী বা শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি।

টিআইবি জানায়, জুলাই-নভেম্বর ২০১৭ সময়ের মধ্যে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে। এছাড়া প্রাসঙ্গিক আইন, বিধিমালা, আদেশ, নির্দেশনা ও দলিলাদিসহ বই, প্রবন্ধ, গবেষণা ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন পর্যালোচিত হয়েছে।

গবেষণায় দেখা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বার্ষিক ১৮-৩৬ মেট্রিক টন স্বর্ণের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এ চাহিদার সিংহভাগ চোরাচালানের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে। উচ্চ শুল্ক, অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা এবং ফ্রেইট ও ইন্স্যুরেন্সের অপ্রাপ্যতা ইত্যাদি কারণে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি না করে চোরাচালানকৃত স্বর্ণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চোরাচালান প্রতিরোধে দায়িত্ব যাদের, তাদের অনেকেই এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। সার্বিকভাবে পুরো স্বর্ণ খাতের সঙ্গে নানাভাবে দুর্নীতি ও অপচর্চার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে অবৈধ চালান আটকের খবর পাওয়া গেলেও এর বিচার হচ্ছে না। গত চার বছরে বিমানবন্দরে আটক করা স্বর্ণের পরিমাণ এক হাজার ৬৭৪ কেজি। বৈধ পথে আমদানি না হওয়ায় স্বর্ণ খাতে সরকারের ন্যূনমত রাজস্ব ক্ষতি বার্ষিক ৪৮৭ থেকে ৯৭৪ কোটি টাকা বলে প্রাক্কলন করেছে টিআইবি। এছাড়া চোরাচালানচক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একাংশ, সরকারি ও বেসরকারি বিমান সংস্থা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একাংশ, সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশসহ বিমানে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহকারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের একাংশের জড়িত থাকার তথ্য গবেষণায় উঠে এসেছে।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ গবেষণায় স্বর্ণ খাতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে স্বর্ণ খাতসংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন; সব স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ীকে তাদের প্রতিষ্ঠানের মজুত সব স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার কর প্রদান সাপেক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধনের সুযোগ প্রদান এবং ব্যবসায়ী কর্তৃক সরকার নির্ধারিত লাইসেন্স গ্রহণ ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নবায়ন বাধ্যতামূলক করা, এছাড়া ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে আনা স্বর্ণালংকারের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ ও শাস্তি নিশ্চিত করা, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর’র সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্ধারিত সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানির ব্যবস্থা, স্বর্ণ আমদানি ও কেনাবেচা অবাধ করেছে এমন দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় স্বর্ণের আমদানি অন্য পণ্যের মতো অবাধ করা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনা করে স্বর্ণ আমদানির শুল্কহার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০