মামলাজটে আটকে আছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১০৬৩২ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: দুর্নীতি ও অভ্যন্তরীণ অনিয়মের কারণে চরম সংকটে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে খেলাপি হয়েও আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরছেন বাবুরা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অর্থঋণ ও অন্যান্য আদালতে ১০ হাজার ৬৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা আটকে আছে। আইনি জটিলতায় টাকাগুলো উদ্ধার করতে পারছে না নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালত ও অন্যান্য আদালতে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ২৮ হাজার ২০৭টি, যেখানে দাবির পরিমাণ ১২ হাজার ৮৯০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৫টি মামলা। নিষ্পত্তি মামলার মাধ্যমে আদায় হওয়া টাকার পরিমাণ মাত্র দুই হাজার ২৫৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এখনও বিচারাধীন মামলা ১৭ হাজার ৪৩২টি। দাবির পরিমাণ ১০ হাজার ৬৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর জুন পর্যন্ত নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তথ্য অনুযায়ী, এ সময় পর্যন্ত ৬৭ হাজার ১১৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

দেশের ব্যাংকবহির্ভূত ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১টির অবস্থান রেড জোনে (সবচেয়ে খারাপ)। এছাড়া ইয়েলো জোনে বা ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ১৮টি এবং গ্রিন বা ভালো অবস্থায় রয়েছে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। তবে প্রতিবেদনে কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

চাপ-সহনশীল (স্ট্রেস টেস্টিং) প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন জোনে ফেলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রতিবেদন তৈরিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, ঋণঝুঁকি, সম্পত্তির (ইকুইটি) মূল্যজনিত ঝুঁকি ও তারল্যের অবস্থাÑএই চার ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া হয়। রেড জোনে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে তদারকি শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী রেড জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন বছরের মূলধন ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা জমা দিতে হয়। এছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়, ঋণ বহুমুখীকরণ, শেয়ারে বিনিয়োগ ও আপৎকালীন তারল্য পরিকল্পনা জমা দিতে হয়। ইয়েলো জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও একইভাবে তদারকি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রিন জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সূচকে অবনতি ঘটলে কঠোরভাবে তদারকি করা হয়। তবে এ জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভালো বলে ধরা হয়।

অনিয়মের মাধ্যমে সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে। নাজুক এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ করে মন্দ ঋণ এ খাতের পরিস্থিতিকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, এটি গত এক দশকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। কভিড মহামারির মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি মিলে ৩৩ এনবিএফআই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটি ছাড়া বাকিগুলো সংকটে রয়েছে।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পিকে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) থেকে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য অবসায়ক নিয়োগ করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত না দিতে পেরে সংকটময় পরিস্থিতিতে রয়েছে। এছাড়া ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও ফারইস্ট ফাইন্যান্সে মন্দ ঋণ ব্যাপক বেড়েছে, যা এ খাতের সামগ্রিক আর্থিক স্বাস্থ্যের অবনতি বলে মনে করা হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আহমদ আলী তার ‘উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখে বোঝা মুশকিল। ব্যাংকে যেসব প্রোডাক্ট পাওয়া যায়, তার সবই রয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয়। দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্পমেয়াদি অর্থায়ন থেকে যত বেশি দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের দিকে ধাবিত হবে, বিপদ ততই ঘনীভূত হবে। এ সমস্যা সমাধানে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা প্রয়োজন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০