শেখ আবু তালেব: নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের নিয়োগকৃত প্যানেল আইনজীবী ব্যাংকের গ্রাহকের রাখা বন্ধকি সম্পত্তি কিনতে পারেন না। এটি স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট), যা বার কাউন্সিল অধ্যাদেশ কর্তৃক ও বার কাউন্সিল অ্যাক্ট কর্তৃক স্বীকৃত। কিন্তু গ্রাহকের বন্ধকি সম্পত্তি নিজ স্ত্রী, বাবা ও আত্মীয়র নামে কিনেছেন প্রাইম ব্যাংকের আইনজীবী মো. কামারুজ্জামান। অর্থের বিনিময়ে এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
প্রাইম ব্যাংকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দায়ের করেছে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান তালুকদার গ্রুপ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। একই অভিযোগ করা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও প্রাইম ব্যাংকের অডিট কমিটির কাছেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
অপরদিকে ব্যাংকও বন্ধকি সম্পত্তির বাইরে কারখানায় থাকা মেশিনারিজ ও গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বি.কে. ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নামে। এমনকি মালিকানা স্বত্ব ও দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছেÑব্যাংকের পক্ষ থেকে এমন চিঠি দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডেভেলপমেন্টের বরাবর। এটি হয়েছে প্রাইম ব্যাংকের যশোর শাখায়।
জানা গেছে, প্রাইম ব্যাংকের যশোর শাখার গ্রাহক হচ্ছে তালুকদার গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম তালুকদার লাইট কাস্টিং। প্রতিষ্ঠানটি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে। ব্যবসায়িক সুনাম ও অর্থ ফেরত পাওয়ায় একপর্যায়ে গ্রুপের নামেই ঋণ দেওয়া শুরু করে ব্যাংকটি। এজন্য ব্যাংকের কাছে সম্পত্তি বন্ধক দেয় গ্রুপটি।
২০১৩ সালে উৎপাদন জটিলতায় ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় গ্রুপটি। ব্যাংকের কাছে খেলাপি হয়ে পড়ে গ্রুপটি। এসময় পাওনা আদায়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্রাহকের বিপরীতে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়। মামলায় একতরফা রায় পায় ব্যাংক। এর বিরুদ্ধে গ্রাহক উচ্চ আদালতে রিট দাখিল করেছেন। মামলা বিচারাধীন থাকাকালেই ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ সুবিধা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী তালুকদার গ্রুপ দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট জমা দেয় প্রাইম ব্যাংকের যশোর শাখায়। এজন্য এক কোটি ২০ লাখ টাকাও জমা দেয়। প্রাইম ব্যাংক পুনঃতফসিলের আবেদনটি গ্রহণ করে অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠায়। উচ্চ আদালতের সম্পৃক্ততা থাকায় ঋণটি পুনঃতফসিল করতে আইনের কোনো ব্যত্যয় হবে কি না, তা জানতে মতামত চেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে মতামত আসার আগেই ব্যাংক গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়। গ্রাহক প্রতিষ্ঠান দাবি করছে, ১৯৮৬ সাল থেকেই ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে তালুকদার গ্রুপ। ওই সময়ে ব্যাংকের কাছে জমিটি বন্ধক ছিল। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ব্যাংক কর্তৃক নিযুক্ত সার্ভেয়ারের হিসাবেই জমিটির মূল্য ছয় কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এ মূল্য ধরেই ব্যাংক গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন সময়ে ঋণ মঞ্জুর করে। বর্তমানে এ সম্পত্তির বাজারমূল্য ১২ কোটি টাকার ওপরে।
কিন্তু নামজারি ছাড়াই ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সম্পত্তিটি মাত্র তিন কোটি ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয় আইনজীবী কামারুজ্জামানের প্রতিষ্ঠানের কাছে। জানা গেছে, এ সম্পত্তি ক্রয় করা হয় আইনজীবীর বাবা, স্ত্রী ও আত্মীয়র নামে। এতে ব্যবহার করা হয় বি.কে. ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডকে। এ প্রতিষ্ঠানও আইনজীবীর বেনামি কোম্পানি।
এ বিষয়ে কোম্পানি আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার রাহাত খলিল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংকের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী কোনো আইনজীবীই এটি করতে পারেন না। এটি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কোনোমতেই তিনি এটি করতে পারেন না।’
বি.কে. ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্টের মালিকানার তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির মোট ১০ হাজার শেয়ারের মধ্যে সাড়ে ৯ হাজার শেয়ারের মালিক হচ্ছেন জুলিয়া জেসমিন, যা মোট শেয়ারের ৯৫ শতাংশ। জুলিয়া জেসমিন হচ্ছেন ব্যাংকের আইনজীবী কামারুজ্জামানের স্ত্রী। কোম্পানির মেমোরান্ডামে জুলিয়া জেসমিনের স্বামীর নাম ব্যবহার করা হয়নি, বাবার নাম ব্যবহার করা হয়। শেয়ারের মাত্র ২০৫টির মালিকানা কামারুজ্জমানের বাবা হোসেন আলীর নামে। অবশিষ্ট ২৫০টি শেয়ারের মালিকানা হচ্ছে মামা সাইফুর রহমানের নামে।
এভাবে পরোক্ষভাবে তিনিই বি.কে. ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণকারী ও সুবিধাভোগী। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী কোনো আইনজীবীই এ সম্পত্তি ক্রয় করতে পারবেন না। এটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক, যা ‘বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অধ্যাদেশ, ১৯৭২’-এ উল্লেখিত আইনজীবীদের পেশাগত আচরণবিধি ও নিয়ামানুবর্তিতার বিধির লঙ্ঘন।
এরই মধ্যে ব্যাংকের পক্ষ থেকে কারখানার জমি, ভবন ও মালামাল ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। দখল নেওয়ার পরই কারখানার সব মেশিনারিজ বিক্রি করে দেয় বি.কে. ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপার, যার বাজারমূল্য সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা।
এসময় পাঁচ টন পণ্য পরিবহন সক্ষমতার একটি কাভার্ডভ্যানও বিক্রি করে দেওয়া হয়, যেটি আইডিএলসি নামক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের অর্থে কেনা। এসব বিক্রি করার বিষয়ে ব্যাংক বা বি.কে. ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পক্ষ থেকে ঋণ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান তালুকদার গ্রুপকে জানানো হয়নি। এখানেই শেষ নয়, আরও দুটি সম্পত্তি ক্রয়ের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
জমি ও কারখানার মেশিনারিজ বিক্রির ব্যাপারে প্রাইম ব্যাংকের যশোর শাখা ব্যবস্থাপক আব্দুর রাফি বলেন, ‘ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনাই সবকিছু হয়েছে। এখানে আমাদের বলার বা করার কিছুই নেই। প্রধান কার্যালয়ই সবকিছু বলতে পারবে।’
সূত্র জানিয়েছে, আইনজীবী কামারুজ্জমানের রক্তের সম্পর্কের এক আত্মীয় প্রাইম ব্যাংকের যশোর শাখায় কর্মরত রয়েছেন। তার সহযোগিতা ও ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই চলে এসব, যা বাংলাদেশ ‘বার কাউন্সিল অধ্যাদেশ, ১৯৭২’-এর পেশাগত আচরণবিধি ও নিয়ামানুবর্তিতার পরিপন্থি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বর্তমান নির্বাহী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পেশাগত আচরণ-সম্পর্কিত আইন পরিপন্থি এটি। যোগসাজশ প্রমাণিত হলে তার সদস্য পদ বাতিল হতে পারে।’
এ বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের আইনজীবী ও ক্রেতা কামারুজ্জমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে। এ সময় তিনি দাবি করেন, ‘পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ কোনোভাবেই ব্যাংকের সম্পত্তি তিনি কেনেননি। তার স্ত্রী, মামা বা কোনো আত্মীয়র নামে কেনা হয়নি।’
জানা গেছে, তালুকদার গ্রুপের সম্পত্তির পাশেই আইনজীবী কামারুজ্জামানের বাড়ি। সামনের জায়গা কিনতেই তিনি ব্যাংকের চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করেন। ওই জায়গায় এখন তিনি আন্তর্জাতিক মানের পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছেন, এমন গুজবই এলাকার মানুষের মুখে মুখে।
এ বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাহেল আহমেদের মন্তব্য জানতে গেলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয় তিনি অসুস্থ। ছুটিতে থাকায় বর্তমানে ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল রহমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চলতি দায়িত্বে রয়েছেন। এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ফয়সাল রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আদালত-সম্পৃক্ত হওয়ায় কোনো মন্তব্য করা সম্ভব হচ্ছে না।’
এ বিষয়ে অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠান তালুকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামসুল আরেফিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংক আমার কোম্পানির সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করেছে আইনজীবীর কাছে। সম্পত্তির বাজারমূল্য ১২ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু মাত্র তিন কোটি ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। মেশিনারিজ ও কাঁচামাল বিক্রির টাকাও সমন্বয় করেনি ব্যাংকঋণ নেওয়া অর্থের পরিমাণ থেকে। এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’
আইনজীবী কামারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, ‘আমি বা আমার কোনো আত্মীয় এ সম্পত্তি ক্রয় করেনি।’