Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 5:08 am

মামলার জালে আটকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১১,৫৫২ কোটি টাকা

রোহান রাজিব: অর্থঋণ আদালতে এখন ব্যাংকের পাশাপাশি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণের বিপরীতে মামলার সংখ্যা ও দাবির পরিমাণ বেড়েছে। বর্তমানে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ অনাদায়ী রয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা আটকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, মামলার সংখ্যা অধিক হওয়ায় মামলার তারিখ ধার্যকরণে এ দীর্ঘসূত্রতা। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলাগুলো নিষ্পত্তিকরণে বিলম্ব হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন তারা। এর মধ্যে রয়েছেÑএকই আদালতে অধিক মামলা, বিচারকের সংকট ও মামলার বিচারক বদলি, মামলার সংখ্যার তুলনায় আদালতসংখ্যক কম থাকা। পাশাপাশি ওয়ারেন্ট জারি হওয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ দীর্ঘসূত্রতা, কিছু মামলার বিপরীতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ, বিবাদীর উকিল পক্ষের অনিচ্ছা, মামলার বিবাদী কর্তৃক বিভিন্ন উপায়ে সময়ক্ষেপণ, ঋণখেলাপি কর্তৃক প্রদত্ত ঠিকানায় তাদের না পাওয়া এবং বিবাদীদের আত্মগোপন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশের ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৪ হাজার ৭০২টি মামলার বিপরীতে ১১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা আটকে রয়েছে আদালতে; যা ২০২১ সাল শেষে ছিল ৩ হাজার ৯১৯টি মামলার বিপরীতে ৮ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মামলা বেড়েছে ৭৮৩টি। এসব মামলার বিপরীতে গত এক বছরে ৩ হাজার ৩৪ কোটি টাকার দাবি বেড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কায়সার হামিদ শেয়ার বিজকে বলেন, অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা অনেক বেশি। সেই অনুপাতে আদালতের সংখ্যা ও বিচারক কম। তাছাড়া আদালতে আবেদন করে খেলাপি গ্রাহকরা লম্বা সময় প্রার্থনা করেন এবং মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে তারা আদালতে হাজির করেন না। ফলে মামলার অভিযোগ গঠন ও বিচার প্রক্রিয়া ঝুলে যায়।

তিনি আরও বলেন, খেলাপি গ্রাহকদের একটি নির্দিষ্ট অংশ জমা দিয়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়ার সুযোগ রয়েছে। খেলাপি গ্রাহক এ সুযোগের অপব্যবহার করছে। অন্যদিকে অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে। এসব কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা হয়। মামলা দীর্ঘসূত্রতার কারণে খেলাপি গ্রাহক থেকে টাকা আদায় করা যাচ্ছে না।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৮০ মামলার বিপরীতে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এফএএস ফাইন্যান্সের ৯৮টি মামলার বিপরীতে ১ হাজার ৭১১ কোটি, এরপর ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ২৬৫ মামলায় ৮৭৯ কোটি, লংকাবাংলার ১ হাজার ৪০১ মালার বিপরীতে ৭৮৪ কোটি এবং আইডিএলসির ১ হাজার ৫৯৩টি মামলার বিপরীতে ৬৮৯ কোটি টাকা আটকে রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী মো. রুহুল আমিন ভূঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, অর্থঋণ আদালতের পুরো বিচার প্রক্রিয়াটাই দীর্ঘমেয়াদি। মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লাগার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে যে কারণগুলো সব মামলার ক্ষেত্রে বলা যায়, সেটা হচ্ছে সমন জারিতে অনেক সময় লাগে। বিবাদী পক্ষ নি¤œ আদালত থেকে মামলা উচ্চ আদালতে নিয়ে যায়। উচ্চ আদালতে মামলাজট থাকায় শুনানিতে দেরি হয়। আবার অনেকে রিট মামলা করেন। রিটের চূড়ান্ত শুনানিতেও অনেক সময় লেগে যায়।

তিনি আরও বলেন, অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হলেও টাকা না আদায় হওয়ার কারণ হলোÑবড় গ্রাহকদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই না করা। এতে ঋণের ক্ষেত্রে যেসব জামানত কাগজপত্রে দেখানো হয়, তা বাস্তবে নেই। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান টাকা ঋণ আদায় করতে পারে না। এসবই হচ্ছে কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। এ ছাড়া মালিক পক্ষ ঋণ নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। তখন কর্মকর্তারা বাধ্য হয়ে ঋণ দিয়ে দেয়। এ খাতের জন্য এটা বড় সমস্যা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, মামলা পরিচালনায় অভিজ্ঞ প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ, নিয়মিত মামলার তদারকি এবং আদালতের চাহিদামতো দ্রুত তথ্য সরবরাহ করতে হবে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করতে নিয়মিত যোগাযোগ ও পত্রিকার মাধ্যমে মামলার সমন জারির ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ দক্ষ রিকভারি টিম নিয়োগ, বিবাদীদের বন্ধকিকৃত সম্পত্তি নিলামের মাধ্যমে বিক্রির চেষ্টা এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী সুদ মওকুফের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তিকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।

বর্তমানে ব্যাংক খাতে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ১৮৯টি বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে আছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘মামলাগুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্ভাবনমূলক উদ্যোগ থাকলে ভালো হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলেও কোনো উপায় বের করতে পারে।’