আবুজার গিফারী: মানুষের অধিকার আদায়ের রাষ্ট্রীয় ও আইনগত পন্থা হলো আদালতে মামলা করা। আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার যৌক্তিক বা আইনগত অধিকার আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ফিরে পায়। রাষ্ট্রের প্রতিটা নাগরিকের মামলা করার আইনগত অধিকার আছে। সংবিধান’-এর ৩১নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে আইনের আশ্রয়লাভের অধিকারের কথা উল্লেখ আছে। সুতরাং আমাদের কাছে সহজেই অনুমেয় যে, যখনই কেউ তার অধিকার নিয়ে শঙ্কিত থাকবে বা আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, তখনই সে আইনের আশ্রয় লাভ করার অধিকারী। একজন ব্যক্তির আইনগত বা মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের আইনগত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আমাদের বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থায় অধিকাংশ মামলা স্বত্ব বা জমি-জমা ও বিয়েবিচ্ছেদ-সংক্রান্ত। সাধারণত মামলার প্রকৃতি দুই ধরনেরÑদেওয়ানি ও ফৌজদারি। প্রথমত, জমিজমা বা সম্পদ এবং পদসংক্রান্ত মামলাকে দেওয়ানি মামলা বলা হয়। অন্যদিকে মারামারি, চুরি, ডাকাতি, খুন, যখম, প্রতারণা, দস্যুতা, ধর্ষণ, অপহরণ, বে-আইনি সমাবেশ, ইভটিজিং, জালিয়াতি বা মিথ্যা সাক্ষ্যদান-সংক্রান্ত মামলাকে ফৌজদারি মামলা বলা হয়। সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বিচারাধীন মোট মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি। তার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে ২৩ হাজার ৬১৭টি। হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছে চার লাখ ৮৯ হাজার ৬৮টি। অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৪৩টি। (সূত্র: জাগো নিউজ; ২৭ আগস্ট, ২০২০)। আর এই মামলাগুলো পরিচালনা করার জন্য বিচারকের সংখ্যাটা বেশ নগণ্য। আপিল বিভাগে বর্তমানে বিচারপতির সংখ্যা আটজন, হাইকোর্ট বিভাগে ৯৪ জন ও অধস্তন আদালতে আছেন এক হাজার ৮১২ জন। সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আপিল বিভাগে মামলা বিচারের জন্য বিচারকপ্রতি রয়েছে দুই হাজার ৯৫২টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক প্রতি রয়েছে পাঁচ হাজার ২০২টি মামলা। অধস্তন আদালতে বিচারকপ্রতি মামলা আছে এক হাজার ৭৫০টি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে মোট জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে বিচারকদের সংখ্যা যুক্তরাজ্যে ১৫ হাজার ৯২৭ জনের বিপরীতে একজন, যুক্তরাষ্ট্রে এক হাজার ১৪৭ জনের বিপরীতে একজন, অস্ট্রেলিয়ায় ২৪ হাজার ১১০ জনের বিপরীতে একজন এবং কানাডায় ৩১ হাজার ১৮৬ জনের বিপরীতে একজন। নিউজিল্যান্ডে ১১ হাজার ৫৫৪ জনের বিপরীতে একজন ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৭৭ হাজার ৬২২ জনের বিপরীতে একজন বিচারক আছেন। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের এক লাখ ৩৭০ জনের বিপরীতে একজন বিচারক আছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মামলাজট কোন পর্যায়ে তা সহজেই বোধগম্য।
গত এক দশকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট থেকে অধস্তন সব আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি বিচারকের সংখ্যা। সে সময়ে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকের সংখ্যা যা ছিল, তুলনামূলকভাবে এখন তা আরও কমেছে। ২০১০ সালে আপিল বিভাগে ১১ জন বিচারপতি ছিলেন, এখন আছেন মাত্র আটজন। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক ছিলেন ১০২ জন, বর্তমানে আছেন ৯৪ জন। তবে অধস্তন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে আছেন এক হাজার ৮১২ জন। আগে ছিলেন এক হাজার ৬০০ জন বিচারক। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, বিচার বিভাগের চলমান মামলাজট নিরসনে যত দ্রুত সম্ভব অন্তত পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ দিতে হবে।
সারা দেশে অনেক মামলা আছে, এখনও আদালত কর্তৃক যেগুলোর নিষ্পত্তি হয়নি। যেমন, সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড যেটি ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত হয়েছিল। আট বছর অতিবাহিত হলেও মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি। কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর হত্যা মামলাটিরও ঢিমেতাল অবস্থা। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ গণধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার চার বছর পার হলেও এখনও মামলার রায় হয়নি। ত্বকী হত্যা সংঘটিত হয় ২০১৩ সালে। তারপর কেটে গেছে সাত বছর, কিন্তু এখনও মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। বরগুনার আলোচিত খুন রিফাত হত্যার এক বছর শেষ হলেও মামলা যুক্তিতর্ক পর্যায়েই থেমে আছে। পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এসব মামলা নিষ্পত্তি হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। আবার কিছু মামলার রায় হয়ে গেলেও আসামি পক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করায় আপিল পর্যায়ে আটকে আছে সহস্রাধিক মামলা। যেমনÑফেনীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা, গাজীপুরের আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার রায় হয়েছে, কিন্তু তিনটি মামলাই বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এসব মামলার ফরিয়াদি পক্ষরা আপিল বিভাগের রায়ের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
মামলাজটের প্রধান ও অন্যতম কারণ হলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বিচারকসংখ্যা। আদালতে এজলাস সংকট। ফলে অধস্তন আদালতে সকালে একজন বিচারক বসেন, আবার বিকালে একই এজলাসে আরেকজন বিচারক বসেন। বিচারকদের সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় পেশকার, সেরেস্তাদার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাও বেশ অপ্রতুল। একজন মধ্যম পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা যতটা সহায়ক লোকবল নিয়ে কাজ করেন, তার থেকে বিচারকেরা অনেক কম লোকবলের সহায়তায় বেশি কাজ করেন। তাছাড়া সাক্ষ্য ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে দীর্ঘদিন সময় ব্যয়, আইনজীবীদের দূরদর্শিতার অভাব, সাধারণ মানুষের আইন সম্পর্কে বিরূপ ধারণা থেকে অসহযোগিতার মনোভাব এবং তথ্য-উপাত্তের আধুনিকায়ন না হ?ওয়া মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার পেছনে বড় অন্তরায়।
মামলা জটের জন্য সাধারণ মানুষও অনেকাংশে দায়ী। যেমন, ছোট-খাটো ইস্যু নিয়ে আদালতে যাওয়া, যেটা সহজে গ্রামেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। আইনজীবীদের খামখেয়ালিপনাও এক্ষেত্রে অনেকটাই দায়ী। উভয় পক্ষের আইনজীবীরা চাইলে মামলার সংখ্যা কমাতে পারেন। আদালতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কারণে-অকারণে আইনজীবী তার মক্কেলের জন্য টাইম পিটিশন চান। আবার অনেক ক্ষেত্রে আইনজীবী তার ক্লায়েন্টকে হাতে রাখার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ইস্যু তৈরি করেন, যেটা মামলাজটের অন্যতম কারণ। বার-বেঞ্চ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বিচারকদের পাশাপাশি মামলার জট কমাতে আইনজীবীদেরও আন্তরিক হতে হবে। কেননা বার থেকে সহযোগিতা না করা হলে শুধু বিচারকেরা চাইলেই এ অবস্থা বদলাতে পারবেন না। ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের অপরাধ করার প্রবণতা অনেক বেশি। একটির পর একটি অপরাধ করতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। যদিও এর পেছনে প্রধান কারণটা হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া বা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় মূল অপরাধীর শাস্তি না হওয়া।
মামলার জট কমাতে যেসব পদক্ষেপ আমাদের এখনই নিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ২২নং অনুচ্ছেদের বাস্তবিকভাবে প্রয়োগ। অর্থাৎ বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মামলা পরিচালনার সিস্টেম, অর্থাৎ একটা মামলা থেকে একাধিক মামলার উদ্ভব যাতে না হয়, তার নিশ্চিতকরণ। তৃতীয়ত, জমিজমা-সংক্রান্ত যত মামলা দায়ের হয়, এগুলোর মূল কারণ হলোÑজমিজমার রেকর্ডপত্র, ফাইলপত্র এবং তা সংরক্ষণের কোনো সুব্যবস্থা না থাকা। একই জমির মালিকানা দাবি করেন চার-পাঁচজন। ফলে একটা জমি থেকে চার-পাঁচটি মামলা উদ্ভব হয়। এ মামলাগুলো কিন্তু আবার শেষও হয় না। চলতে থাকে বছরের পর বছর। সুতরাং রেকর্ডপত্র, ফাইলপত্রসহ অন্যান্য বিষয় ডিজিটাইজড করতে হবে।
উল্লেখ্য, অধস্তন আদালতের বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ার বিধান সকাল ১০টায় এবং শেষ হওয়ার বিধান বিকাল ৪টায়। মাঝখানে এক ঘণ্টার বিরতি। এই সময়টাও কার্যকরভাবে পালন করা হয় না। সকাল ১০টায় আদালত শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কার্যক্রম শুরু হতে সকাল ১১টা লেগে যায়। ফলে এ সময় বাদী-বিবাদী/ফরিয়াদি-অভিযুক্তকে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। একইভাবে মামলাজট কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়াতে হবে। যদিও ২০১২ সালের পর থেকে দেওয়ানি মামলার উভয় পক্ষকে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির আহ্বান করা দেওয়ানি আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটা অবশ্যই ভালো দিক। তবে এখন এটাকে আরও বাস্তবসম্মত রূপ দিতে হবে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে কোনো ঝামেলা ছাড়াই উভয় পক্ষের পূর্ণ সন্তুষ্টিতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। যার ফলে আপিলসহ অন্য আর কোনো নতুন মামলার উদ্ভব হয় না। এখানে সময়, শ্রম ও অর্থের খরচ কমে যায় বলে উভয় পক্ষই জিতে যায়। আমাদের আদালতে বিচারাধীন মামলার বেশ বড় অংশই মিথ্যা বা ফলহীন মামলা। সুতরাং মামলা আমলে নেওয়ার সময় ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। কেননা মামলা বিচার নিষ্পত্তি করে কমানো সম্ভব নয়, দরকার মামলাকে প্রবেশপথে আটকানো। আর যারা অপরকে ক্ষতি করার জন্য মিথ্যা মামলা করে, তাদের দণ্ডবিধির ২১১ ধারার আওতায় এনে দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই মামলা কমানো সম্ভব। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখে বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন, রাজনৈতিক পরিচয় দেখে নয়। সর্বোপরি মানুষকে সচেতন করতে হবে এবং তাদের কোনো অধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। কেননা সরকার যখনই তাদের অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হবে, তখনই তারা আর কোর্টে দৌড়ানোর প্রয়োজন মনে করবে না। ফলে অচিরেই মামলার আধিক্য ও জট কমিয়ে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
abujar.gifary.5614@gmail.com