মায়ের বুকের দুধ শিশুর আদর্শ খাবার

মুসলিমা খাতুন: মায়ের দুধ শিশুর অধিকার। জন্মের পর একটি শিশু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে পুষ্টি প্রয়োজন, তার সবই মায়ের দুধে আছে। তাই মায়ের বুকের দুধই শিশুর শ্রেষ্ঠ খাবার। শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দৈহিক গঠনে মায়ের দুধের অপরিহার্যতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্য যে কোনো বিকল্প দুধের চেয়ে মায়ের দুধের পুষ্টিগুণ বহুলাংশে বেশি। পরিমিত প্রোটিন, ভিটামিন ও রোগ প্রতিরোধ উপাদানের সংমিশ্রণে বুকের দুধ শিশুর জন্য সবচেয়ে আদর্শ খাবার। মায়ের বুকের দুধে ল্যাকটোজ নামক এক বিশেষ ধরনের শর্করা আছে, যা শিশুর শরীরের ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে।

মায়ের দুধ শিশুর জন্য সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। শিশুর প্রথম পুষ্টির জোগানও আসে মাতৃদুগ্ধ থেকে। শিশু জন্মের পর মায়ের বুকে প্রথম যে দুধ আসে, তাকে শাল দুধ বলা হয়। শালদুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালী প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। এর ফলে শিশুর শরীরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ অন্যান্য রোগ-জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। অ্যান্টিবডিতে পূর্ণ শাল দুধ শিশুর বুক ও কানের প্রদাহ, ডায়রিয়া, অ্যাজমা, একজিমা ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করে এবং শিশুর দাঁত ও হাড় মজবুত রাখে।

জন্মের পর শিশুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বুকের শাল দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে। একজন নিকটাত্মীয় বা একজন নার্স এ ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন। নবজাতক ও মাকে একই বিছানায় থাকতে দিতে হবে, যাতে শিশু তার মায়ের সান্নিধ্য পায়। মায়ের পর্যাপ্ত দুধ আসার জন্য অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশি পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। কারণ শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সবকিছুই মায়ের দুধে আছে। বুকের দুধ খেলে শিশুর বৃদ্ধি বাড়ে, সুস্থ থাকে ও সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।

শিশুকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এ সময় অন্য কোনো খাবার, এমনকি পানিও দেয়ার প্রয়োজন নেই। ছয় মাস পর থেকে দু’বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার খাওয়াতে হবে। যেমনÑসবজি দিয়ে খিচুড়ি, ডিম, মাছ, মাংস ও বিভিন্ন ধরনের ফলমূল শিশুর চাহিদা মতো খাওয়াতে হবে।

শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করালে মা ও শিশু দু’জনই উপকৃত হয়। ঞযব ঘধঃরড়হধষ ওহংঃরঃঁঃবং ড়ভ ঐবধষঃয-এর গবেষণায় দেখা গেছে, স্তন্যদানকারী মা প্রসব পরবর্তী বিষণœতায় কম ভোগেন। জšে§র পরই শিশুকে বুকের দুধ দিলে মায়ের শরীর থেকে অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়। এই অক্সিটোসিন জরায়ু এবং এর রক্তনালিকে সংকুচিত করতে সাহায্য করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জন্মের পর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের স্তন ক্যানসারের আশঙ্কা ২৫ শতাংশ কমে, আর জরায়ু ক্যানসারের আশঙ্কা ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে যায়। 

জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুকে শুধু মায়ের দুধ পান করাতে হবে এ বিষয় নিয়ে সরকার, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ আরও অনেক শিশুবান্ধব আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাতৃদুগ্ধ পানের হার আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। দেশে প্রায় ৬৪ শতাংশ শিশু মায়ের বুকের দুধ পান করে থাকে। মাতৃদুগ্ধ পানের হিতকারী ফল অপরিসীম। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মায়ের বুকের দুধের সব ধরনের বিকল্পের বিজ্ঞাপন ও বিপণন সীমিত করতে হবে এবং বিপণনের আন্তর্জাতিক বিধির মনিটরিং ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটিকে উৎসাহিত করতে হবে। সব কর্মজীবী মায়েরা ছয় মাস বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি যাতে পান, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। কর্মস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার এবং অফিস-আদালতে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। সব হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং জনাকীর্ণ এলাকায় মাতৃদুগ্ধ পান সাপোর্ট সেন্টার স্থাপনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

শিশুদের বুকের দুধ পান করানোয় মায়েদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের ৯৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং ট্রেন্ডস ইনিশিয়েটিভ (ডব্লিউবিটিআই) থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে ৯১ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ তালিকায় প্রথম হয়েছে। ২০১৫ সালে এ স্কোর ছিল ৮৬ শতাংশ। ডব্লিউবিটিআইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ‘সবুজ জাতির’ মর্যাদা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের পরেই ৯১ স্কোর নিয়ে শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির প্রতি উচ্চমাত্রার অঙ্গীকারের প্রতিফলনের ফলে এই অর্জন সাধিত হয়েছে।

আমাদের সুস্থ শিশু ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব শিশুকে মায়ের দুধ পান করানো ও ঘরে তৈরি পরিপূরক খাবার খাওয়ানোর হার বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সঙ্গে গুঁড়ো দুধ বা কৌটাজাত শিশুখাদ্যের ব্যবহার ও বিজ্ঞাপন সর্বনি¤œ পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার গুঁড়া দুধের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে মায়ের দুধের পক্ষে সচেতনতা তৈরিতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য অমৃত, সঞ্জীবনী। শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর জন্য মাকে পরিবারের সবাই মিলে সহযোগিতা করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে নাÑশিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধের কোনো বিকল্প নেই।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০