বীর সাহাবী: সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ ও থ্যালাসেমিয়া এই ছয়টি অতিগুরুত্বপূর্ণ রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য সরকারের দেয়া আর্থিক সহায়তার টাকার বড় একটি অংশ সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিভিন্ন জেলার কর্মকর্তারা তছরুপ করেছেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিভিন্ন ভুয়া খাত দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া মারণব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত ৭৫ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা থেকে ছয় কোটি ৭০ লাখ ৫০ হাজার টাকা তাদের পকেটস্থ করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, ডাক্তারের স্বাক্ষর জাল, একই ব্যক্তিকে বারবার অনুদান, রোগী নন তারপরও অনুদান, ভুয়া আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় দেখানো, অনুদান পেতে আবেদন করেননি এমন ব্যক্তিকেও অনুদান এবং ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ও টেস্ট রিপোর্ট ছাড়াই অনুদান দেয়ার মতো জালিয়াতি করে এ টাকা লোপাট করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এমন জালিয়াতির কারণেই প্রকৃত রোগীরা পর্যাপ্ত সেবা পায় না। সরকারের দেয়া আর্থিক অনুদান রোগীদের কাছ পর্যন্ত আসতে আসতে পকেট ভরছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। এতে মারণব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা পড়ছেন জীবন বাঁচানোর হুমকির মুখে। তাদের জীবন বাঁচাতে অর্থের জন্য কঠিন যুদ্ধ করতে হচ্ছে। অথচ কর্মকর্তারা তাদের পকেট ভারী করছেন রোগীদের সহায়তার টাকা নিয়ে।
যেসব উপায়ে এই টাকা কর্মকর্তারা পকেটস্থ করেছেন
একই ব্যক্তিকে বারবার অনুদান প্রদান: নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমাজসেবা অধিদপ্তরের ঢাকার আগারগাঁও, যশোর, নড়াইল, রাজশাহী, গাজীপুর ও ময়মনসিংহে ছয়টি জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা নীতিমালা লঙ্ঘন করে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। কর্মসূচির বিভিন্ন নথিপত্র যাচাই করে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৮ আবেদনকারীকে একই অর্থবছরে দুবার, ১২ আবেদনকারীকে একই অর্থবছরে তিনবার এবং একজন আবেদনকারীকে চারবার চিকিৎসা অনুদান প্রদান করা হয়েছে। ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড ও জš§গত হƒদরোগীর আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নীতিমালা, ২০১৪-এর অনুচ্ছেদ ৮ অনুযায়ী, এক অর্থবছরে একই ব্যক্তিকে এককালীন সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা যায় এবং ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জš§গত হƒদরোগ এবং থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নীতিমালা ২০১৯-এর অনুচ্ছেদ ৯.২.৩ অনুযায়ী আবেদনকারী এক অর্থবছরে একবারের বেশি আবেদন করতে পারবেন না। কিন্তু সেই ৮১ আবেদনকারীকে নীতিমালা-বহির্ভূতভাবে এক অর্থবছরে একাধিকবার চিকিৎসা অনুদান হিসেবে প্রাপ্যের অতিরিক্ত ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।
আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় দেখানো
প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে, মারণব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের বরাদ্দকৃত ৭৫ কোটি টাকা থেকে উদ্দেশ্য-বহির্ভূতভাবে আনুষঙ্গিক খাতে এক কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা তছরুপ করা হয়। যেখানে মন্ত্রণালয় কর্তৃক আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয়ের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি ৬১ হাজার রোগী এই অনুদানের আওতাভুক্ত থাকলেও তার থেকে কম অর্থাৎ ৬০ হাজার ৭৪১ জনকে এই অনুদান দেয়া হয়েছে। বাকি রোগীদের অর্থসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা লোপাট করেছেন।
রোগী না হওয়া সত্ত্বেও অনুদান দেয়া
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কীভাবে রোগী না হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসা অনুদান দেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে সরকারের এক কোটি ৫১ লাখ টাকা সমাজসেবা কর্মকর্তারা তছরুপ করেছেন।
নিরীক্ষাকালে প্রতিষ্ঠানের বাজেট, মঞ্জুরিজ্ঞাপন পত্র, ব্যাংক বিবরণী, জেলাভিত্তিক চিকিৎসা অনুদান বরাদ্দের কপি, চেক বিতরণের মাস্টার রোলের কপি, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর এবং অনুদানপ্রাপ্তদের আবেদনপত্র যাচাইকালে দেখা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আবেদনকারী প্রকৃতপক্ষে রোগী না হওয়া, অন্যের ব্যবস্থাপত্র ফটোকপি, অসম্পূর্ণ আবেদন, ডাক্তারের প্রত্যয়ন ব্যতীত আবেদন, নীতিমালায় বর্ণিত রোগসমূহ ব্যতীত অন্য রোগের রোগী হওয়া, সংশ্লিষ্ট রোগের টেস্ট রিপোর্ট না থাকা, ভুয়া জাতীয় পরিচয়ত্রের বিপরীতে আবেদন সত্ত্বেও ৩০২ ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা করে মোট এক কোটি ৫১ লাখ টাকা চিকিৎসা অনুদান প্রদান করা হয়েছে।
আবেদনপত্র ছাড়াই চিকিৎসা অনুদান
নিরীক্ষায় দেখা গেছে, আবেদনপত্র ছাড়াই চিকিৎসা অনুদান দেয়ার নামে সরকারের দুই কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
নথিপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জেলা সমাজসেবা কার্যালয় নড়াইলে ২৮১ জন ব্যক্তিকে চেক প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু আবেদনপত্রের রেজিস্টার এবং মাস্টার রোলের কপি অনুযায়ী ৯৯ ব্যক্তির আবেদনপত্র সমাজসেবা অধিদপ্তর ঢাকার মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়নি। অর্থাৎ আবেদনপত্র ছাড়াই নীতিমালা-বহির্ভূতভাবে ৯৯ ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা হারে মোট ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা চিকিৎসা অনুদান হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলা সমাজসেবা কার্যালয় বগুড়া, চয়াডাঙ্গা, মাগুরা, ঠাকুরগাঁও, নড়াইল, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, মুজিবনগর, কুষ্টিয়া, নেত্রকোনা ও শেরপুরে ৪৮০ ব্যক্তিকে আবেদন না করা সত্ত্বেও ৫০ হাজার টাকা হারে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয়েছে। চিকিৎসা অনুদানের জন্য আবেদন গ্রহণ ছাড়াই ৫৭৯ জনকে চেক প্রদান করার মাধ্যমে কর্মকতারা সরকারের দুই কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিজেদের পকেটে ভরেছেন।
ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ও টেস্ট রিপোর্ট ছাড়াই অনুদান
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোগীর আবেদন ফরমের সঙ্গে রোগ নির্ণয়ের সপক্ষে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ও টেস্ট রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। তাছাড়া জেলা সিভিল সার্জন কর্তৃক রোগীকে শনাক্ত করার প্রমাণও পাওয়া যায়নি। ‘ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জš§গত হƒদরোগ এবং থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নীতিমালা, ২০১৯’-এর অনুচ্ছেদ ৯.২.১ অনুযায়ী, ছয়টি রোগের ক্ষেত্রে আবেদনকারীদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ও টেস্ট রিপোর্টসহ নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে এবং অনুচ্ছেদ ৯.২.৪ অনুযায়ী, জেলার ক্ষেত্রে জেলা সিভিল সার্জন রোগীকে শনাক্ত করবেন। এক্ষেত্রে এই নীতিমালা অনুসরণ না করে সরকারের ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে।
ডাক্তারের স্বাক্ষর জাল করে অনুদান
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৭৯ জন ক্যান্সার, কিডনি ও স্ট্রোকে প্যারালাইজড রোগীকে অধ্যাপক ডা. আছিয়া (এমডি, নেফরোলজি), ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, (বিসিএস স্বাস্থ্য, মেডিসিন) ডা. মো. নোমান মিয়া, (বিসিএস স্বাস্থ্য, মেডিসিন) ডা. মো. হাসানুজ্জামান, (সহকারী অধ্যাপক, অনকোলজি), প্রফেসর গোলাম মোস্তফা (রেডিয়েশন অনকোলজি) ও ডা. মো. মাহবুব আলম মজুমদার (নেফরোলজি) দ্বারা প্রত্যয়ন করা হয়। এই প্রত্যয়নপত্রগুলোয় একই ডাক্তারের নামযুক্ত সিল ব্যবহার করা হলেও স্বাক্ষরে অমিল পাওয়া যায়। জটিল এ ছয়টি রোগে আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নীতিমালা, ২০১৯-এর অনুচ্ছেদ ১১(১) অনুযায়ী, ভুল তথ্য দিলে অথবা দাখিলকৃত কাগজপত্রের সঠিকতা প্রমাণিত না হলে আর্থিক সহায়তা বাতিল করা যাবে। এক্ষেত্রে এই নীতিমালা অনুসরণ করে আবেদনপত্র বাতিল না করে উল্টো ৭৯ জনকে ৫০ হাজার টাকা করে চিকিৎসা অনুদানের অর্থ প্রদান করার মাধ্যমে সরকারের ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা সমাজসেবার কর্মকর্তারা তছরুপ করেন।
এসব বিষয়ে জানতে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালে তারও কোনো জবাব দেননি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরে মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামালকে ফোন করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী জানান, তিনি হজ পালনে সৌদি আরব অবস্থান করছেন। ২৬ জুলাই দেশে ফিরবেন।
পরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের চিকিৎসা সহায়তা শাখার (ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস) উপপরিচালক মো. কামাল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এগুলো হচ্ছে বিভিন্ন জেলার হিসাবের ব্যাপারে অডিট আপত্তি জানিয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে বিভাগীয় মাধ্যমে সময়মতো জবাব না আসায় আমরা সময়মতো জবাব দিতে পারিনি। তবে আমরা জবাব রেডি করছি, আগামী রোববারের মধ্যে ইনশাআল্লাহ দিয়ে দেব।’
এখন পর্যন্ত কেমন জবাব এসেছেÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো পুরোপুরি সব জবাব আমরা পাইনি। তবে যেগুলো পেয়েছি এবং রোববারের মধ্যে পাব, সেগুলোই মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। এরপর ১৩ তারিখে আমরা এ বিষয়ে একটি মিটিং করব।’