ইসমাইল আলী: কয়েক বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাড়ছে। এছাড়া গত অর্থবছর দুই দফা বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির পর লোকসান গুনেছে বিদ্যুৎ বিতরণকারী সব সংস্থা ও কোম্পানি। এর পরিপ্রেক্ষিতে এক বছরের মাথায় আবারও বাড়ল গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। মার্চ থেকে গড়ে সাড়ে আট শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। তবে উচ্চ শ্রেণির গ্রাহকের বিল বেড়েছে বেশি হারে। আজ এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়ার কথা রয়েছে।
সূত্রমতে, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কথা গত সপ্তাহে জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত মঙ্গলবারও কতটুকু দাম বাড়বে তার আভাস দিয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে দেখা গেছে, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে ভারিত গড়ে ৭০ পয়সা বা প্রায় সাড়ে আট শতাংশ। তবে আবাসিকে সর্বনিম্ন ছয় দশমিক ৫৪ থেকে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ বাড়বে দাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের অপরিকল্পিত উদ্যোগে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এতে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর। ফলে বেড়ে গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। এতে একদিকে সরকারের ভর্তুকি বাড়ছে। আবার বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির ফলে বিতরণ কোম্পানিগুলোও লোকসানে পড়েছে। এজন্য দাম বাড়াতে এত তোড়জোড়। এর মাধ্যমে মূলত বিদ্যুতের উচ্চ উৎপাদন ব্যয়ের বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, গ্রাহক পর্যায়ে গত বছর মার্চে পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। সে সময় গড় মূল্যহার দাঁড়ায় ৮ টাকা ২৫ পয়সা। এ বছর মার্চে সে মূল্যহার বেড়ে হচ্ছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। অর্থাৎ বিদ্যুতের দাম বাড়ছে প্রায় আট দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে কম বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে লাইফ লাইন (০-৫০ ইউনিট) গ্রাহকদের। তাদের বিল বাড়ছে সর্বনিম্ন ২৮ পয়সা। বর্তমানে এই শ্রেণির গ্রাহকদের বিল প্রতি ইউনিটে ৪ টাকা ৩৫ পয়সা। নতুন মূল্যহার কার্যকর হলে তা দাঁড়াবে ৪ টাকা ৬৩ পয়সা।
এদিকে প্রথম ধাপে (০-৭৫ ইউনিট) বিদ্যুৎ বিল ৪ টাকা ৮৫ পয়সা। আট দশমিক ৪০ শতাংশ বা ৪১ পয়সা বেড়ে তা দাঁড়াচ্ছে ৫ টাকা ২৬ পয়সা। দ্বিতীয় ধাপে (৭৬-২০০ ইউনিট) বর্তমানে বিদ্যুৎ বিল ৬ টাকা ৬৩ পয়সা, যা বাড়ছে ৫৭ পয়সা বা আট দশমিক ৬০ শতাংশ। এতে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল পড়বে ৭ টাকা ২০ পয়সা।
সেচ গ্রাহকদের বিল গুনতে হয় বর্তমানে ৪ টাকা ৮২ পয়সা। তা বাড়ছে ৪৩ পয়সা বা আট দশমিক ৯০ শতাংশ। এতে সেচে বিল পড়বে প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ২৫ পয়সা। তবে বিদ্যুৎ ব্যবহার যত বেশি হলে বিল তত বেশি হারে বাড়বে। এতে আবাসিকে সবচেয়ে বেশি হারে বিদ্যুৎ বিল বাড়বে ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বের গ্রাহকদের। এ শ্রেণির গ্রাহকদের বর্তমান বিল দিতে হয় ১৩ টাকা ২৬ পয়সা হারে। তা ১ টাকা ৩৫ পয়সা বা ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়ে হচ্ছে ১৪ টাকা ৬১ পয়সা।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, লাইফ লাইন গ্রাহকদের বিলে ছাড় দেয়ায় তাতে মাসে খরচ বাড়বে সর্বোচ্চ ২২ টাকা। প্রথম ধাপের (০-৭৫ ইউনিট) গ্রাহকদের বিল বাড়বে মাসে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা। দ্বিতীয় ধাপের (৭৬-২০০) গ্রাহকদের বিল বাড়বে মাসে সর্বোচ্চ ১২২ টাকা। সেচে বিদ্যুতের ব্যবহার মাসে ৫০০ ইউনিট পর্যন্ত থাকলে বিল বাড়বে ২৬২ টাকা। আর কোনো আবাসিক গ্রাহক মাসে এক হাজার ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে খরচ বাড়বে সর্বোচ্চ এক হাজার ৪৪৩ টাকা।
বিদ্যুতের এ দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চ উৎপাদন ব্যয় গ্রাহকদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০২১-২২ অর্থবছর গড় ব্যয় ছিল ৮ টাকা ৮৪ পয়সা। গত অর্থবছর তা বেড়ে হয়েছে ১১ টাকা ৪ পয়সা। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমায় প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সামান্য কমে হয়েছে গড়ে ১০ টাকা ৫৬ পয়সা।
পিডিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল ৭ টাকা ১১ পয়সা। চলতি অর্থবছর ছয় মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ টাকা ৭৪ পয়সা। তবে ক্যাপাসিটি চার্জের ক্ষেত্রে ঘটেছে তার উল্টো। ২০২২-২৩ অর্থবছর জ্বালানিবহির্ভূত (ক্যাপাসিটি চার্জ ও অন্যান্য ব্যয়) খরচ ছিল গড়ে ৩ টাকা ৯৩ পয়সা। চলতি অর্থবছর ছয় মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৮২ পয়সা। আর ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল ৫ টাকা ৩৭ পয়সা এবং জ্বালানিবহির্ভূত ব্যয় ছিল ৩ টাকা ৪৭ পয়সা।
জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছর কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ১৫ টাকা ২০ পয়সা। চলতি অর্থবছর ছয় মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ৬২। কয়লার উৎপাদন বাড়ায় ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলো বসে থাকছে। এতে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় গড় ব্যয় বেড়েছে। গত অর্থবছর এ কেন্দ্রগুলোয় গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ২০ টাকা ৯০ পয়সা। চলতি অর্থবছর ছয় মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ টাকা ৪ পয়সা।
অন্য জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে গ্যাসে গত অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ৫ টাকা। চলতি অর্থবছর ছয় মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ৬ পয়সা। ডিজেলে গত অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ৪০ টাকা ৪০ পয়সা। বেশকিছু ডিজেলচালিত কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ টাকা ৬৩ পয়সা। গত অর্থবছর হাইড্রো পাওয়ারের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ৩ টাকা ৫৫ পয়সা। চলতি অর্থবছর ছয় মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৯১ পয়সা।
অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির (বায়ু, সৌর) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গত অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ১৫ টাকা ৭৭ পয়সা। চলতি অর্থবছর ছয় মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা ৭৭ পয়সা। গত অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে গড় ব্যয় পড়ে ৭ টাকা ৮৩ পয়সা। চলতি অর্থবছর ছয় মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ২৪ পয়সা। মূলত ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে ব্যয় বাড়ছে। এর বাইরে গত অর্থবছর ভারতের আদানির গড্ডা কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে গড় ব্যয় পড়েছিল ১৪ টাকা ২ পয়সা। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম কমায় চলতি অর্থবছর ছয় মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকা ৫৫ পয়সা।