শেয়ার বিজ ডেস্ক: হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বাধা-হামলা ও আটকের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের হামলায় অনেক জায়গায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আহত হন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির সমর্থনে গতকাল বুধবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাইকোর্ট অভিমুখে পদযাত্রা আটকে দেয় পুলিশ। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা দোয়েল চত্বরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখান। সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দেন ঢাবির সাদা দলসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
তারা হাইকোর্টের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে শিশু একাডেমির সামনে তাদের ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয় পুলিশ। সেখানে পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা ও ধস্তাধস্তি হয়। ঘটনাস্থল থেকে এক শিক্ষার্থীকে পুলিশ তুলে নেয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেন ঢাবির লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নুসরাত জাহান চৌধুরী এবং প্রভাষক শেহরীন আমিন ভূঁইয়া। আন্দোলনকারীদের দাবি, পুলিশ শেহরীন আমিনের ‘হাত মুচড়ে দেয়’ এবং ‘ধাক্কা দিয়ে’ মাটিতে ফেলে দেয়। এতে তিনি হাঁটুতে ব্যথা পান।
পরে শেহরীন আমিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ তুলে নিতে চাইলে আমি বাধা দিই। বললাম- তার অপরাধ কী। তল্লাশি করার থাকলে আপনি আমাদের সামনে করুন। কিন্তু তিনি (পুলিশ সদস্য) কোনো কথা না শুনে বলপ্রয়োগ করেন। আমার হাত মুচড়ে দিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে যেতে চায় পুলিশ, আবার ধরতে গেলে ধাক্কা দিলে আমি পড়ে যাই। হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছি, একটু তবে ‘হাত মুচড়ে যাওয়ায়’ বেশি ব্যথা পেয়েছি।’ অন্যদিকে মৎস্য ভবনের মোড় থেকে মিছিল নিয়ে আরেক দল শিক্ষার্থী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে দিয়ে কদম ফোয়ারার সামনে পৌঁছালে তারাও পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। শিক্ষার্থীরা ফিরে যাওয়ার সময় সেখান থেকে দুজনকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। নাহিদ ও আরিফ নামে ওই দুই শিক্ষার্থী নিজেদের ঢাবির মাস্টার দা সূর্যসেন হলের ছাত্র পরিচয় দেন।
আন্দোলনকারীরা জানান, হাইকোর্টের মোড়ে দুই শিক্ষার্থীকে গাড়িতে তুললে আইনজীবীরা প্রিজন ভ্যানটি সামনে থেকে ঘিরে ধরেন এবং তারা শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দেয়ার দাবি জানান। পরে ঢাবির ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম মোস্তাফিজুর রহমান ও মো. কামরুজ্জামান পুলিশের সঙ্গে গিয়ে বেলা ২টার দিকে দুই শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনেন। এছাড়া শিশু একাডেমির সামনে থাকা শিক্ষার্থীদের একটি দল কদম ফোয়ারার দিক থেকে এসে হাইকোর্ট মোড়ের সামনে অবস্থান করে বিভিন্ন সেøাগান দেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় বিচার দাবি করে বিভিন্ন সেøাগান দেন। বেলা ৩টার দিকে তারা কর্মসূচি শেষ করে চলে যান। হাইকোর্টের ভেতরে আইনজীবীদের একটি দলও মিছিল করেন।
এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশের বাধা ভেঙে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আদালত চত্বরেও প্রবেশ করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা আদালত চত্বরে অবস্থান করছিলেন। এ সময় এনেক্স ভবনের সামনে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা বিক্ষোভকারীদের বাধা দেন। তখন মৃদু ধাক্কাধাক্কি হয়। তবে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল করছেন। গতকাল বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে জড়ো হন। সেখানে প্রথমে ফটকের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কে পুলিশ তাদের দাঁড়াতে না দিলেও ফটকের অদূরে পদচারী- সেতুর নিচুর নিচে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা সেøাগান দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর শিক্ষার্থীরা বাধা উপেক্ষা করে প্রধান ফটকে অবস্থান নেন।
দুপুর ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে এগোলে নগরের সুবিদবাজার এলাকায় পুলিশ তাদের আটকে দেয়। সেখানে ১৫ মিনিট বাক?বিতণ্ডার পর শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা ভেঙে কোর্ট পয়েন্ট অভিমুখে রওনা দেন। এর মধ্যে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী লংমার্চে যোগ দেন। হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে এবং ৯ দফা দাবি আদায়ে গতকাল বগুড়ায় শিক্ষার্থীদের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে। ফলে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আদালত চত্বর পর্যন্ত যেতে পারেননি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। প্রায় দুই ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ করেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সামান্য ধাক্কাধাক্কি হয়। তবে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।
৯ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে বরিশালে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। এতে ৪ সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটক করেছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও কর্মসূচিতে অংশ নেয়া একাধিক ব্যক্তি জানান, বেলা ১১টার পর নগরের সদর রোডসংলগ্ন কাঠপট্টি সড়কের মুখে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রতিবাদ মিছিল করার চেষ্টা করলে পুলিশ প্রথমে বাধা দেয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েকজন অভিভাবককেও এ কর্মসূচিতে একাত্ম হতে দেখা যায়। একপর্যায়ে বাধার মুখে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। পরে সিটি কলেজের গলির মুখে শিক্ষার্থীদের আটকে দেয়া হয়। আরও শিক্ষার্থী এক জোট হয়ে সদর রোডে অবস্থান নিলে ধাওয়া দিয়ে তাদের ফকিরবাড়ির রোডে আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সেøাগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে।
আন্দোলনকারীরা জানান, শিক্ষার্থীরা সদর রোড ত্যাগ করে ফজলুল হক অ্যাভিনিউয়ে বরিশাল জেলা জজ আদালতের সামনে অবস্থান নিলে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে আবারও লাঠিপেটা শুরু করে পুলিশ। এ সময় অন্তত চারজন আহত হন। সেখান থেকে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটক করা হয়।
সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। শিক্ষার্থীরা বাধা ডিঙিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। গতকাল দুপুরে সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তবে এতে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। যশোরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মানববন্ধন কর্মসূচি পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়েছে। সেই সঙ্গে পুলিশের লাঠিপেটা ও ধাওয়ায় অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে যশোর শহরের ধর্মতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি রংপুরে গতকাল অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তবে শহরের পরিস্থিতি ছিল থমথমে। শিক্ষার্থীদের হাতে সেøাগান-সংবলিত প্ল্যাকার্ড ও মাথায় বাঁধা লাল রিবন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করতে তারা জড়ো হচ্ছিলেন দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ মাঠসংলগ্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় ১৯ শিক্ষার্থীকে আটক করার পাশাপাশি কয়েকজনের মাথার লাল রিবন খুলে নেয় পুলিশ।
ময়মনসিংহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি পুলিশ বেষ্টনীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টায় কর্মসূচি শুরু হয়। সমাবেশস্থলের দুই পাশে ছাত্রলীগের কর্মীরা অবস্থান নেয়ায় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে রাখে শিক্ষার্থীদের। নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ পদযাত্রা করেছেন হাজারো শিক্ষার্থী। যশোরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। সেখান থেকে অন্তত ছয় শিক্ষার্থীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করছে তারা। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা-জয়দেবপুর আঞ্চলিক সড়কের শিববাড়ী এলাকা অবরোধের চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন।
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষকেরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। তারা সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ১০ দফা দাবির কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের ৯ দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম ক্যাম্পাসে মিছিল ও প্রতিবাদী সমাবেশ করেছে। ৯ দফা না মানা হলে তারা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি জানাবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের হয়রানি না করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।