রোহান রাজিব: বছরের পর বছর ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। একদিকে আদায় হচ্ছে না খেলাপি ঋণ। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মেয়াদি আমানত ও ধার হিসেবে রাখা টাকাও ফেরত পাচ্ছে না। এই দুয়ের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয় সোনালীর সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের ফলে বিভিন্ন শাখা থেকে আমানত তোলার চাপ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত আমানত তোলার চাপে ব্যাংকের দৈনিক কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এক হাজার কোটি টাকার বিশেষ তারল্য সহায়তা চাওয়া হয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আবেদনটি নাকচ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তা চেয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
জানা যায়, সোনালীর সঙ্গে একীভূতের খবরে ব্যাংকটি থেকে মেয়াদপূর্তি ও মেয়াদপূর্তির আগেই বিভিন্ন শাখায় আমানত তোলার চাপ বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে ৬০১ কোটি ৪২ লাখ টাকা গ্রাহক তুলে নিয়েছে। আবার ৫টি প্রতিষ্ঠান ৪৬৬ কোটি টাকার আমানত তোলার জন্য আবেদন জানিয়েছে। এর মধ্যে তিতাস গ্যাস কোম্পানি ৬০ কোটি, বেপজা ৮০ কোটি, ঢাকা ওয়াসা ২১৬ কোটি, পল্লী বিদ্যুৎ ২০ কোটি এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৯০ কোটি টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির মার্চ শেষে আমানত ছিল ৩ হাজার ৬১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। জুন শেষে তা কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৭৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২৯ জুলাই শেষে আরও কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২০ কোটি ৩২ লাখ টাকায়। ব্যাংকটির মোট আমানতের ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বা ৮০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক। বাকি ৫৫০ কোটি টাকা ব্যক্তি আমানতকারীর। যদিও ব্যক্তি আমানত তোলার কোনো চাপ নেই। তবে প্রাতিষ্ঠানিক আমানত তোলার চাপের কারণে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের আলোকে তাদের আমানত নবায়নের জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। যদিও অনেক নবায়ন করতে রাজি হননি। তাই গ্রাহকের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ইতোমধ্যে সোনালীর থেকে ধারের ১৬০ কোটি, বিলে বিনিয়োগকৃত ১১০ কোটি টাকা ও অন্যান্য আদায়সহ মোট ২৭০ কোটি টাকা আমানতকারীদের ফেরত দেয়া হয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলো বাকি আমানত ফেরতের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে।
ব্যাংকটি জানিয়েছে, অতিরিক্ত আমানত উত্তোলনের কারণে ব্যাংকের দৈনন্দিন তারল্য চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যার কারণে ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণ দুরূহ হয়ে পড়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংকটির ২০২৪ সালের মধ্যে এসএলআর সংরক্ষণ করতে হবে। তাই ব্যাংকটি রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য ট্রেজারি বিল ও বন্ড ক্রয় করা হয়েছে। তবে বর্তমানে যেভাবে আমানত তোলার চাপ রয়েছে। ফলে ব্যাংকের পক্ষে এসএলআর সংরক্ষণ করা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আবার আমানত তোলার কারণে ব্যাংকটির নির্ধারিত ঋণ ও আমানত অনুপাত বজায় রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের চলমান সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ তারল্য সুবিধার আওতায় দীর্ঘমেয়াদি এক হাজার কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আবেদনটি নাকচ করেছে।
খেলাপি ঋণে ডুবে আছে বিডিবিএল: ২০১৮ সালে ব্যাংকটির দেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১২৯ কোটি টাকায়। ২০২১ সালে ঋণ আরও বেড়ে হয় ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ঋণ অল্প বাড়ে, দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকায়। আর ২০২৩ সালে ঋণ অবশ্য কিছুটা কমে, নেমে আসে ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকায়। যদিও চলতি বছরের জুন শেষে তা আরও কমে নেমে আসে ২ হাজার ২৩০ কোটি টাকায়।
তবে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার সব সময় উঁচুতে ছিল। ২০১৮ সালে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪৬ শতাংশ বা ৮৮৯ কোটি টাকা ছিল খেলাপি। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮২ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৪২ শতাংশ। তবে গত জুন শেষে খলাপি ঋণের হার ছিল ৪২ দশমিক ৩০ শতাংশে।
১৪ প্রতিষ্ঠানে আটকা ৫৪০ কোটি টাকা: তথ্য অনুযায়ী, দুুটি ব্যাংক ও ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিডিবিএলের ৫০৪ কোটি টাকা আটকা। এর মধ্যে পদ্মা ব্যাংকে ৫৯ কোটি ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ১ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশে ২৮০ কোটি, ফাস্ট ফাইন্যান্সে ১৩ কোটি ৬০ লাখ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালে ৮ কোটি ৮৮ লাখ, আভিভা ফাইন্যান্সে ৪৫ কোটি ৫০ লাখ, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিরিয়াল ফাইন্যান্সে ২২ কোটি ১৩ লাখ, এফএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ১৫ কোটি ৮৫ লাখ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ১ কোটি ১৮ লাখ, জিএসপি ফাইন্যান্সে ৩ কোটি ৪৯ লাখ, ফিনিক্স ফাইন্যান্সে ১৪ কোটি, পিপিলস লিজিংয়ে ২৮ কোটি এবং প্রিমিয়ার লিজিংয়ে ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এসব প্রতিষ্ঠান মেয়াদপূর্তির পরও অর্থ ফেরত দিচ্ছে না।
বিডিবিএলের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে আগ্রাসীভাবে ব্যাংকিং করার কারণেই মূলত প্রতিষ্ঠানটি দুর্দশায় পড়েছে। এটা বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো ভূমিকা নেয়নি। জানতে চাইলে বিডিবিএলে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি শচীন্দ্র নাথ সমাদ্দার বলেন, বর্তমানে আমাদের তারল্য সংকট নেই। কিছু আমানত নিয়ে আসার কারণে এই সংকট কেটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যেটা চাওয়া হয়েছে তা আরও আগের। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা নাকচ করেও দিয়েছে।