বিষমুক্ত সবজি চাষে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি মালচিং। আজ এর বিস্তারিত তুলে ধরা হলো
সবজি চাষে ব্যবহার করতে হয় নানা ধরনের কীটনাশক। এসব কীটনাশক কিংবা ওষুধের ফলে মানবদেহের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এ নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচতে প্রয়োজন কীটনাশকের কম ব্যবহার ও বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করা। জানা যায়, চীন ও জাপানের বিষমুক্ত সবজি চাষের একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি মালচিং। বর্তমানে বাংলাদেশেও কৃষি বিভাগের উদ্যোগে পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে বিভিন্ন স্থানে এ পদ্ধতিতে বিষমুক্ত সবজি চাষ শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে নওগাঁর রানীনগর উপজেলায় দেশের প্রথম মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করা হয়েছে সবজি। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত বিষমুক্ত সবজির ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় উৎসাহিত হচ্ছে স্থানীয় অনেক চাষি।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের জন্য পরিবেশবান্ধব নানা প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তির মধ্যে অন্যতম মালচিং।
মালচিং পদ্ধতিতে প্রথমে পরিমাণমতো সার দিয়ে জমি প্রস্তুত শেষে সারি তৈরি করা হয়। মাটির সারিগুলো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর সারিগুলোর নির্দিষ্ট দূরত্বে পলিথিন ফুটো করে সবজির চারা রোপণ করা হয়। চারা রোপণের পর থেকে শুধু দেখভাল করা ছাড়া আর তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না। তাই পরিশ্রম হয় কম। মাটির সারিগুলো পলিথিনে ঢেকে থাকার কারণে বাইরে থেকে কোনো ছত্রাক কিংবা রোগবালাই সবজি চারায় আক্রমণ করতে পারে না বলে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় কম। এ পদ্ধতিতে চাষ করা সবজির গাছ ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত হয় না। ক্ষেত পরিচর্যার জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না বলে উৎপাদন খরচও তুলনামূলক কম হয়। এছাড়া এ পদ্ধতিতে যেমন সবজি গাছ সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে, তেমনি ফলন হয় দ্বিগুণ।
উপজেলার বেতগাড়ী বাজারের কৃষক মাসুদ রানা এ নতুন পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করেছেন। তিনি বলেন, প্রথমে ইউটিউবে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ দেখি। পরে স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শ ও সহযোগিতায় পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে টমেটো চাষ করি। এ পদ্ধতিতে তিনি টমেটো চাষ করে অভাবনীয় ফলন পেয়েছেন। বিষমুক্ত সবজি চাষের জন্য এটি উত্তম পদ্ধতি। কারণ, এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করলে ক্ষেতে তেমন রোগবালাইয়ের আক্রমণ হয় না বলে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় খুবই কম। এছাড়া ক্ষেত পরিচর্যায়ও তেমন সময় ব্যয় করতে হয় না। ফলে খরচ কম লাগে। তাই লাভের পরিমাণটা তুলনামূলক বেশি। আগামীতে এ পদ্ধতিতে মরিচ, তরমুজসহ অন্য সবজি চাষ করবেন বলে জানিয়েছেন মাসুদ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে বের হয়ে পরিবেশবান্ধব ও সহজলভ্য পদ্ধতিতে সবজি চায়ের জন্য কৃষককে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে মালচিং পদ্ধতি আমাদের দেশে চালু করা হয়েছে। এটি বেশ সহজলভ্য, লাভজনক ও বিষমুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করলে লাভবান হবে কৃষক। এতে সবজি চাষে আগ্রহী কৃষককে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করব।
মালচিং কী?
‘মালচিং’ এসেছে ‘মালচ’ শব্দ থেকে। ‘মালচ’ শব্দের অর্থ ‘মাটি ঢেকে দেওয়া’। মৃত অথবা পুরোনো, শুকনো বা কাঁচা পাতা, বিচালি বা খড়, কচুরিপানা প্রভৃতি দিয়ে মাটি ঢেকে চাষ করার প্রথা চালু রয়েছে বিশ্বের অনেক দেশে। চাষের জমিতে এসব বস্তু দিয়ে যখন ঢেকে দেওয়া হয়, তখন তাকে ‘মালচ’ বলা হয়। তবে বর্তমানে চাষাবাদ বাণিজ্যিক ও আধুনিকীকরণ হওয়ায় এ পুরোনো প্রথা বর্জন বা ত্যাগ করে এক ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে, যা ‘মালচিং’ নামে পরিচিত।

মালচিং আধুনিক চাষাবাদের এক উন্নত পদ্ধতি, যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ফসলের দ্রুত বৃদ্ধি হয়। তাছাড়া এ পদ্ধতির মাধ্যমে চাষের অনুকূল পরিবেশও তৈরি করা সম্ভব।
মালচিং আমাদের দেশে খুব একটা পরিচিত নয়। তাই মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয় না বললেই চলে। মূলত জমিতে চাষের জন্য প্রথমে সারি তৈরি করে তার ওপর এক ধরনের পাতলা প্লাস্টিকের থান বিছিয়ে সেই থানের ওপর ফসল অনুযায়ী ছিদ্র করতে হয়। এরপর এ ছিদ্রের ভেতর দিয়ে বীজ বা চারা রোপণ করে ফসল উৎপাদন করা হয়।
ব্যবহারে যত সুবিধা…
বর্তমানে কৃষিজমিতে সেচ দেওয়ার জন্য অধিক পরিমাণে বিদ্যুৎচালিত মোটর ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের বেশ অপচয় হয়। তবে মালচিং পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা হলে পানি ও বিদ্যুতের অপচয় রোধ করা যাবে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচ কমিয়ে দ্বিগুণ লাভবান হওয়া যায়। মালচিং ব্যবহারের কিছু সুবিধা উল্লেখ করা হলো:
পানি সংরক্ষণ
ফসলের ক্ষেতে আর্দ্রতা সংরক্ষণে মালচিং বিশেষভাবে উপকারী। কারণ, মালচিং ব্যবহারের ফলে মাটির রসের বাষ্পায়ন প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ ফসল ক্ষেতের পানি সূর্যের তাপ ও বাতাসে দ্রুত উড়ে যায় না। এতে জমিতে রসের ঘাটতি পড়ে না। ঘাটতি না হওয়ায় সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বর্ষাকালে শুধু বৃষ্টির পানি হলেই চলে। কারণ, এ পানি প্লাস্টিকের ছিদ্র দিয়ে শেকড়ে পৌঁছায়। এর মাধ্যমে পানির যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ সম্ভব। তখন আর সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মালচিং ব্যবহারের ফলে জমিতে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ আর্দ্রতা সংরক্ষণ হয়

আগাছা নিয়ন্ত্রণ
মালচিংয়ের ছিদ্র দিয়ে রোপণ করা গাছ বেরিয়ে আসে। আর বাকি অংশটুকু ঢেকে থাকায় আগাছা বের হতে পারে না। অর্থাৎ, প্লাস্টিকে ঢেকে থাকার কারণে সেখানে সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে না। ফলে সালোকসংশ্লেষণ সংগ্রহ করতে না পারায় ওই অংশে আগাছা জন্মায় না। এতে মাটির পুরো খাদ্য গাছ একাই পায়। ফলে ভালো হয় ফলন।
পোকা নিয়ন্ত্রণ
মালচিংয়ের ফলে পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নিমাটোড বা ফসলে কৃমির আক্রমণ রোধ হয়। পলিথিন-জাতীয় এ শিটের ওপরের রঙ সিলভার, নিচের রঙ কালো। সিলভারে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়। ফলে পোকা বসতে পারে না। গাছে পোকা ধরে কম। এতে গাছ ও ফল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না
সারের ব্যবহার হ্রাস
এ পদ্ধতি ব্যবহারে জমি ও গাছে তুলনামূলক কম সার দিতে হয়। এতে চাষির খরচ কমে যায়।
দ্রুত অঙ্কুরোদ্গম
প্লাস্টিক শিট দিয়ে মাটি ঢেকে রাখার ফলে ঢাকা অংশের উষ্ণতা রাত ও শীতকালে তুলনামূলক তপ্ত থাকে। ফলে বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম দ্রুত হয়। এছাড়া শীতকালে মালচ ব্যবহার করলে মাটিতে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ধরে রাখা সম্ভব।
ফলের রঙ ধারণ
প্লাস্টিক মালচিংয়ের প্রতিফলিত আলো ফলের রঙ ধারণে সহায়তা করে।
মালচিং তৈরির পদ্ধতি
নানাভাবে মালচিং করা যায়। মালচিংয়ের প্রধান উপকরণ পলিথিন। সাধারণ পলিথিন থেকে আলাদা এটি। বিশেষ ধরনের পলিথিন দিয়ে মালচিং করা হয়। এ পলিথিন বিছানোর কাজটি হাতেই যেমন করা যায়, তেমনি ছোট বড় মেশিন বা ট্রাক্টরের মাধ্যমেও করা যায়। তবে বাংলাদেশে মালচিং এখনও জনপ্রিয় হয়নি। তাই মেশিন তেমন একটা ব্যবহার করা হয় না বা পাওয়া যায় না। তাই চাষিরা হাত দিয়েই করেন।

সবজি চাষে মালচিং পদ্ধতির ব্যবহার বেলে ও দোঁআশ মাটির ক্ষেত্রে উপযোগী। এ পদ্ধতিতে চাষ করতে হলে প্রথমে জমি তৈরি করে নিতে হবে। মালচিং করার আগে মাটির সঙ্গে প্রয়োজন মতো জৈব সার মিশিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। এক বেড থেকে আরেক বেডের দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত। এরপর তৈরি করা বেডে বিশেষ এ পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে। বিছানোর সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এ সময় পলিথিন টানটান করে বিছিয়ে দেওয়া উত্তম। এতে আগাছা জন্মানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। পলিথিনের নিচে যাতে পানি প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বেডের দুই ধারের পলিথিন চার থেকে ছয় ইঞ্চি মাটির গভীর ঢুকিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে, যা প্লাস্টিকগুলোকে মাটির সঙ্গে ধরে রাখতে সাহায্য করে। এখন পলিথিন বিছানো বেডে মাপযোগে ফুটো করে তাতে বীজ বপন বা চারা রোপণ করতে হবে। মালচিংয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত হলো ড্রিপ বা বিন্দু সেচ। এমন সুযোগ যদি না থাকে তাহলে এক একটি সারির পর ছোট নালা তৈরি করেও সেচ দেওয়া যায়। প্লাস্টিকগুলো একাধিকবার একই ধরনের ফসলের চাষের ক্ষেত্র ব্যবহার করা সম্ভব।