মুন্সীগঞ্জ, শেখ মোহাম্মদ রতন ঃ সালামের বয়স যহন দুই মাস, তহন ওর বাবার লগে আমার ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছিলো। এরপর এই পোলাডারে লইয়া আমি বাঁইচ্ছা আছিলাম। বাড়ির সবাই আমারে দ্বিতীয়বার বিয়া দিতে চাইছিল। পোলাডার মুহের দিক চাইয়া বিয়া করি নাই। সালাম আছিল আমার সব আশা ভরসা।
আগুনে পুইড়া আমার সালাম শেষে, সালামের লগে আমার সুখ, আশা-ভরসা সব শেষ হইয়া গেলো।
কথা গুলো বলতে বলতে বিলাপ করছিলেন মালয়েশিয়ায় কারখানায় বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া শ্রমিক আবদুস সালামের মা তাছলিমা বেগম।
নিহত আবদুস সালাম(২৪) নারায়ণগঞ্জের মহিউদ্দিনের ছেলে। বাবা-মায়ের বিয়ে বিচ্ছেদের পর মা তাছলিমা বেগমের সঙ্গে নানার বাড়িতে থাকতেন তারা। দেড় বছর আগে ধার-দেনা করে মালেশিয়া গিয়েছিলেন সালাম।সেখানে মামা তাহের আলীর সঙ্গেই থাকতেন তিনি। কাজ করতেন জোহর রাজ্যের ইস্কান্দার পুতেরের গেলাং পাতার এসআইএলসি শিল্প এলাকায় রাসায়নিক কারখানায়।
গত ১০ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাজ করার সময় ওই কারখানায় বিষ্ফোরণ হয়। সে বিস্ফোরণে কারখানার ভেতরে থাকা সালাম, সালামের মামাসহ তিন বাংলাদেশি শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হন। তাদের শরীরে অধিকাংশ পুড়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার বিকেল ৫টার মারা যায় সালাম। একই ঘটনায় মারা যান সালামের মামা আবু তাহের(৩২) এবং একই গ্রামের গ্রামের রাজ্জাক ভূঁইয়ার ছেলে জব্বার আলী(৪২)।
সালামের মা তাছলিমা বেগম বলেন, পোলায় কইত বিদেশ যাইবো,আমাগো সব কষ্ট শেষ অইব।নিজেরা আলাদা জায়গা কিনবো,বাড়ি করবো।ওই বাড়িতে আমারে রাখবো।আমারতো সব শেষ হইয়া গেলো।পোলাডার শরীরে আগুন লাগার পর বুঝতে পারছিল হয়তো অয় আর বাঁচবো না। আমার লগে আর একটা কথাও কয় নাই অয়। ওর লগে যে বাংলাদেশীরা থাকতো, তাগো কইছিল, আমারে ফোন দিয়া কইস আমার মায় যেন আমারে মাফ কইরা দেয়।
সোমবার (১৪ অক্টোবর) বিকালে নিহত সালাম এবং আবু তাহেরদের বাড়িতে গিয়ে শোকের মাতম দেখা যায়। ঘরের বাহিরে বসে কাঁদছিলেন সালামের মা। একপাশে নির্বাক বসে ছিলেন সালামের নানি এবং একই দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে গত শনিবার ভোররাতে মারা যাওয়া আবু তাহেরের মা খায়রুন নেছা।
এক বাড়িতে দুটি মৃত্যুতে পুরো পরিবারটি ভেঙে পড়েছে।ঘরের ভেতরে নির্বাক হয়ে বিছানায় পরে ছিলেন নিহত আবু তাহেরের স্ত্রী মাকসুদা বেগম। বাড়িতে স্বজনরা এসে বারবার তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
আবু তাহেরের মা খায়রুন নেছার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, কত মানুষের বাড়িতে, কত দুর্ঘটনার কথা হুনতাম।কোনদিনও ভাবি নাই আমাগো বাড়িতে এমন দুর্ঘটনা আইবো। আমার পোলা আর নাতি আগুনে পুইড়া মইরা যাইবো।
এসময় খায়রুন নেছা তাঁর ছেলে এবং নাতির লাশ চেয়ে বলেন,পোলা আর নাতি জীবিত তো আর ফিরা আইবো না। বিদেশের মাটিতেও ওগো লাশ পইড়া আছে। আমাগো দেশের সরকার লাশগুলো দ্রুত আনোনের ব্যবস্থা কইরা দেওক।
একই দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে গত ১১ অক্টোবর সালাম, আবুতাহেরদের স্বজন প্রতিবেশী জব্বার আলী (৪২) মারা যান। জব্বার আলী রমজানবেগ এলাকার আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়ার ছেলে।
সোমবার জব্বার আলীদের বাড়িতে গিয়েও শোকার্ত পরিবেশ দেখা যায়। ঘটনার পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও স্বাভাবিক হতে পারছেন না জব্বার আলীর স্বজনরা।
জব্বার আলীর বাবা আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেন, প্রতিদিন আমার ছেলে আমাকে ফোন করতো। আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতো। বুধবার গভীর রাতে আমাকে নিয়ে একটা দুস্বপ্ন দেখে ফোন করেছিল। আমি জব্বারকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, আল্লাহ যার হায়াত যতক্ষণ রেখেছেন সে ততক্ষণ বেঁচে থাকবেন। বৃহস্পতিবার সকালে জব্বার ফোন দেয়নি। আমি ফোনের আশায় থেকে নিজেই ফোন করেছিলাম। সে আর ফোন ধরেনি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জানতে পারলাম আমার ছেলের শরীরে আগুন লেগেছে। পরদিন শুক্রবার সে মারা গেছে।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিফা খান জানান, “আমাদের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করা হয়েছে। তাদের লাশ আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নেওয়া হবে। পরিবারগুলোর পাশে থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে।”
মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফাতেমা তুল জান্নাত বলেন, মরদেহগুলো দ্রুত কিভাবে দেশে আনা যায় সে বিষয়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। সেই সঙ্গে নিহতের পরিবার গুলোর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা করা যায় সব টুকু করা হবে।#