মজনুর রহমান আকাশ, গাংনী (মেহেরপুর): মাস চারেক আগে দালালের হাত ধরে সুদূর মালয়েশিয়ায় গিয়ে এক রকম বন্দি ছিলেন মেহেরপুরের গাংনীর ২০৮ যুবক। তিনটি ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন তারা। এরই মধ্যে দুটি ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ১৫০ বাংলাদেশিকে হেফাজতে নিয়েছে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ। গতকাল সোমবার ভোরে এক ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশি যুবকরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তাদের পরিবারকে। তবে তাদের কোনো এজেন্সি ছাড়িয়ে আনতে যায়নি বলেও জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন।
মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানো তেকালা গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে সাজেদুর রহমান মিঠুন গতকাল ভিডিও বার্তায় তার স্ত্রী সোনিয়া খাতুনকে জানান, ভোর থেকেই ইমিগ্রেশন পুলিশ চেরাস ক্যাম্পের চারদিকে অবস্থান নেয়। পরে সম্মিলিতভাবে অভিযান চালিয়ে ১০৫ জনকে আটক করে গাড়িতে করে নিয়ে গেছে। কয়েকজনের কাছ থেকে তারা মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা কেউ বলতে পারেনি। তবে ভিডিওতে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন মিঠুন। তিনি হাসানের হাত ধরে মালয়েশিয়ায় গমন করেন।
সাহেবনগরের মোজাম্মেল হক জানান, তার ছেলে তৈয়বুজ্জামান নয়ন গ্রামের দালাল সুরুজের হাত ধরে মালয়েশিয়ায় গেছেন। চার মাস কোনো কাজ দেয়া হয়নি। চেরাস ক্যাম্পে সকালে ওই দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশ রেড দিয়ে তার ছেলে নয়নসহ ১০৫ জনকে ধরে নিয়ে গেছে। একটু সুযোগ বুঝে মোবাইল ফোনে তারা বিষয়টি জানিয়েছে। তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনও কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এখান থেকে ঢাকাস্থ মুছা ইন্টারন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজকে জানানোর পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, বরং নানা ধরনের হুমকি দিচ্ছে।
কুঞ্জনগরের বকুল হোসেন জানান, তার ছেলে রাজুসহ ৪৫ জনকে সে দেশের পুলিশ গতকাল সকালে ধরে নিয়ে গেছে। চার মাস ধরে রাজুসহ তাদের সালাক সালাকা শহরের একটি ক্যাম্পে বন্দি রেখেছিল দালালরা। কোনো কাজ না দিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রেখেছিল। তাছাড়া দিনে একবার খাবার দিত। দেশে ফেরানোর জন্য আকুতি-মিনতি করলেও কেউ কোনো কথা শোনেনি। বিভিন্ন সময়ে কাজ দেয়ার দিন-তারিখ দেয়। অবশেষে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তাদের প্রত্যেকজনের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, শরিফুল ইসলাম নাড়া মেম্বর, আমিনুল ইসলাম শাহীন, হাফিজ কেরানী, মাসুদ, লিটন, হাসান আলী দপ্তরি ও মুনসুর আলীর সমন্বয়ে গঠিত চক্রটি ঢাকার বনানীতে অবস্থিত মুসা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাহেবনগরের আব্দুল আওয়ালের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠায়। ৭৪ জনকে সেরে ক্যাম্প বাগান নামক স্থানে, চেরাসে ১০৪ জনকে এবং সালাক সালাকা শহরে ৬০ জনসহ ২৩৮ জনকে একরকম বন্দি রাখে। তাদের মূল কোম্পানির নামে কাগজপত্র তৈরি করলেও কোনো কাজ দেয়া হয়নি। এর আগে তাদের পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তারা নিজেদের আয়ত্তে নেয়।
প্রতারণার শিকার রুবেলের স্ত্রী রাহেলা খাতুন জানান, ভিটেমাটি বিক্রি করা ছাড়াও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ গেছে রুবেল। গত তিন মাসে কোনো কাজ পায়নি। একটি টাকাও দেশে পাঠাতে পারেনি। খাবার খরচের জন্য প্রতি মাসেই টাকা পাঠাতে হয় তার কাছে। একদিকে সংসারের কষ্ট, অন্যদিকে দেনাদারদের চাপ। সব মিলিয়ে দিশাহারা। এরই মধ্যে আবার পুলিশের হাতে আটক হয়েছে। কী হবে এখন সেটা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না তারা।
এদিকে মুসা এন্টারপ্রাইজের কর্মী ও দালাল সাহেবনগর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি হাসান জানান, মূল কোম্পানির জন্য তাদের রিক্রুট করলেও চায়না কোম্পানির জন্য যুবকদের মালয়েশিয়া আনা হয়। কোম্পানির লোকজন ও এজিন্সিকে দিয়ে তাদের উদ্ধার করার চেষ্টা করা হচ্ছে।