নাদের হোসেন ভূঁইয়া: প্রথম কভিড-আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পরপর যেন সোনার হরিণ হয়ে যায় মাস্ক, দাম বেড়ে হয়ে যায় চার-পাঁচগুণেরও বেশি। হাহাকার পড়ে মাস্ক নিয়ে। গরিব মানুষ তো টাকার জন্য মাস্ক সংগ্রহ করতেও পারেনি। তখন সবেমাত্র করোনা এলো বলে। আক্রান্ত রোগীর হার ছিল যেমন কম, ঠিক তেমনি মাস্ক পরা নিয়ে ছিল তুমুল প্রতিযোগিতা। একের অধিক মাস্ক পরতেও দেখা গেছে। কিন্তু আজ যখন মাস্কের দাম নি¤œমুখী, আজ যখন করোনায় সারা দেশ কাঁপছে, তখন কোথায় গেল সেই মাস্ক, কোথায় গেল মানুষের সচেতনতা? রাস্তায় দাঁড়ালে এখন মনেই হবে না দেশে মহামারি চলছে। গত বছর ডেল্টা ভেরিয়েন্ট যখন চরম আকার ধারণ করে, আক্রান্তের হার যখন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হয়, তখন সরকার একটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তা হলো ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’। সেই নীতি দেশের মানুষের মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু এখন নতুন ধরন ওমিক্রন যখন দেশ কাঁপাচ্ছে, আক্রান্ত রোগীর হার যখন পুরোনো রেকর্ড ভেঙে ৩২ শতাংশ, তখন কি এই নীতি বাস্তবায়ন করা যেত না?
বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ ছাড়াল। ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যু থেকে এ পর্যন্ত যারা মারা গেছেন তাদের সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজারের বেশি। আশার কথা হচ্ছে, এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখের বেশি। করোনার ডেল্টা ধরনের রেশ কাটিয়ে দেশের সবকিছু যখন একটু একটু করে স্বাভাবিক হওয়ার পথে, ঠিক তখনই করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের হানায় আবারও অস্বাভাবিক হতে শুরু করছে সবকিছু। এরই মধ্যে স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ শনাক্ত রোগীর হার ৩২ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী মৃত্যুর হারও। মাস্ক পরা নিয়ে জনগণের চরম উদাসীনতা জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশ আগামীতে করোনার এক বিধ্বংসী অবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে বারবার সচেতনতার কথা বলা হয়েছে, করা হয়েছে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন। মাস্ক না পরার অপরাধে জরিমানা গুনতে হয়েছে অনেক মানুষকে। এত কিছুর পরও সচেতনতা রয়ে গেছে উপেক্ষিত। মাস্ক পরা থেকে বিরত বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাফেরা দেখলে মনে হয় না বাংলাদেশে মহামারি চলছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে বর্তমানে চলছে পর্যটন মৌসুম। করোনার ডেল্টা ধরন কাটিয়ে পর্যটন স্পটগুলো খোলার সময় বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে। কিন্তু কোথায় গেল সেই স্বাস্থ্যবিধি? ছুটির দিনগুলোয় কক্সবাজারের অবস্থা দেখলে মনে হবে, করোনা কাটিয়ে স্বাধীন আমরা। মাঝে মাঝে কক্সবাজারে অভিযানে নামেন ভ্রাম্যমাণ অদালত। অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় পুরো চিত্র। তখন সবার মুখে মুখে দেখা যায় মাস্ক। এই পরিস্থিতি দেখে প্রশ্ন জাগে মানুষ কি সচেতন হয়ে মাস্ক পরল, নাকি ভয়ে। যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে হয়ে থাকে, তাহলে এই সচেতনতার মূল্য কোথায়?
মাস্ক পরা নিয়ে তো ওজুহাতেরও শেষ নেই; কারও নাকি নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়, আবার কারও সমস্যা গরম লাগাÑআরও কত কিছু! একজন অসচেতন মানুষ মাস্ক না পরে শুধু নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলছে তা নয়, সে ঝুঁকিতে ফেলছে তার পরিবারসহ গোটা দেশকে। মাস্ক যে শুধু করোনা থেকে রক্ষা করে তা নয়, ধুলাবালি ও নানা রকম ভাইরাস থেকেও রক্ষা করে। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানীরা জানান, মানুষ মাস্ক পরে শুধু করোনাভাইরাসকে পরাস্ত করাতে পারবে না, তার সঙ্গে লকডাউন-পরবর্তী সময়ে ভাইরাসটির বিপক্ষে লড়ার কার্যকর ও শক্তিশালী অস্ত্র হলো মাস্ক। গবেষণায় দেখা গেছে, কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তা টের পাওয়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা আগে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আক্রান্ত হলেও কোনো উপসর্গ নেই। এজন্যই বেড়ে গেছে মাস্কের গুরুত্ব। হাঁচি, কাশি, এমনকি কথা বলার সময় মুখ থেকে বের হওয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলকণায় ভর করে ভাইরাসটি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো সরাসরি চোখ, নাক ও মুখের মাধ্যমে দেহে ঢুকতে পারে। আবার ভাইরাসগুলো কোনো পৃষ্ঠতলে পড়লে তা স্পর্শের মাধ্যমে পরোক্ষভাবেও শরীরে ঢুকতে পারে। তাই তো ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে মাস্ক পরার বিকল্প নেই। এ অবস্থায় কিছু দিন আগে সরকারের তরফ থেকে একটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়‘নো মাস্ক নো সার্ভিস।’ বলা হয়েছে, মাস্ক না পরলে সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে কোনো রকম সেবা মিলবে না। তখন মানুষ স্বাভাবিকভাবে মাস্ক না পরলেও কাজকর্ম কিংবা সেবা পাওয়ার জন্য মাস্ক পরতে শুরু করে। ব্যবস্থাটি ছিল যথেষ্ট সুন্দর। তাই করোনার এই দুঃসময়ে আবারও ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি কার্যকর করা হওয়া উচিত।
সরকার এরই মধ্যে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ বিবেচনা করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করছে। কিন্তু এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যমেলা চলমান। হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত মেলায় ভিড় জমাচ্ছে। সঙ্গে আছে বিভিন্ন সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মকাণ্ড। কিন্তু কথা ছিল ১০০ জনের বেশি মানুষ নিয়ে কোনো সভা-সমাবেশ করা যাবে না। কিন্তু কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চলছে সবকিছু। এক্ষেত্রে সরকারের কোনো কঠোর পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে অন্য সবকিছু চলমান রেখে কি করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব! সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী দেশের সব জেলা প্রশাসককে কঠোর হতে নির্দেশ দিয়েছেন। মাস্ক পরার জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা করা হচ্ছে রাজধানীসহ দেশে অনেক জেলা ও উপজেলাগুলোয়। সচেতন করা হচ্ছে জনগণকে, বিতরণ করা হয়েছে মাস্ক। কিন্তু এতে কতটাইবা সচেতন হচ্ছে মানুষ, কতটাইবা সচেতন হলো মানুষ বিবেক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতক্ষণ অভিযান করে, ঠিক ততক্ষণ সচেতন মানুষ। এরপর তো ঠিক আগের অবস্থা বিদ্যমান। তাহলে এটাকে কি সচেতনতা বলা যায়, নাকি ভয়! মানুষ সামান্য জরিমানার ভয়ে মাস্ক পরছে, কিন্তু তাকে তো বোঝানো যাচ্ছে না করোনার ভয়াবহতা। মানুষ সচেতন না হলে এমন আইনি অভিযানে কতটা সুফল আসবে, তা নিয়ে তো প্রশ্ন থেকেই যায়। অনেকে হয়তো মনে করতে পারেনÑ‘আমরা টিকা নিয়েছি, তাই আমরা মাস্ক না পরলেও নিরাপদ।’ কিন্তু দুই ডোজ টিকা নিয়ে মৃত্যু হয়েছে, এমন রেকর্ডও রয়েছে। যদিও টিকা নিলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং মৃত্যুর হার অনেকটাই কমে আসে, কিন্তু করোনা সংক্রমণ এড়াতে পারে না। শুধু মাস্ক পরে এবং নিয়মিত হাত ধুয়ে আমরা করোনাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।
সর্বোপরি করোনাযুদ্ধ জয় করার একমাত্র হাতিয়ার জনসচেতনতা। সবার আবশ্যই মনে রাখা দরকার‘ভয় নয়, সচেতনতাই জয়।’
শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ফেনী সরকারি কলেজ