‘এরপর হলো কি, কাঠুরে তো সেই নদীর পাড়ে বসেই কান্না শুরু করলো, হঠাৎ করে নদী থেকে উঠে এলো…’ এভাবেই গল্পটিকে ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছুটা লজ্জা, কিছুটা সংকোচ নিয়ে তোতলাতে তোতলাতে অনেক মানুষের মাঝে ছোট্ট শিশুটি বলে গেলো তার পড়া গল্পটি। গল্পের বইটি মাসের শুরুতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে সে পড়তে নিয়েছিল। মাসের শেষ মঙ্গলবার ‘বাগেরহাট-পিরোজপুর’ ইউনিটের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির তত্ত্বাবধানে এমন আড্ডা জমে ওঠে। সবার পড়া শেষে বইটি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় নানা দিক উঠে আসে।
এ একটি ইউনিটের মধ্য দিয়ে সারা দেশে চলা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। রাজধানীসহ দেশের ৫৬টি জেলার ২৫০টি উপজেলায় এর কার্যক্রম চালু রয়েছে। লাইব্রেরির গাড়িগুলো দেখতে সুন্দর। সাতটি ছোট, ছোট-মাঝারি, মাঝারি, বড়-মাঝারি ও বড় আকারের গাড়ি রয়েছে। আকৃতি অনুযায়ী চার হাজার থেকে ১৭ হাজার বই থাকে একটি গাড়িতে। আর রাস্তার প্রশস্ততার ওপর নির্ভর করে গাড়ি চলাচলের রাস্তা ঠিক করা হয়। প্রতিটি লাইব্রেরি প্রতি সপ্তাহে গ্রাম ও শহরের গড়ে ৪০টি এলাকায় গিয়ে আধঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময়ে চলে বই দেওয়া-নেওয়া। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির বর্তমান সদস্য এক লাখ ২৫ হাজার।
আড্ডায় উপস্থিত পড়–য়া ও জানাশোনা মানুষরা বইয়ের নানা দিকের স্পষ্ট ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন অজানা অনেক বিষয়ের প্রতি। ফলে বাড়তে থাকে জানার আগ্রহ। এভাবে মাসের পর মাস চলছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির ‘বই আড্ডা’।
প্রসঙ্গক্রমে চীনের একটি প্রবাদের কথা বলা যায়। ‘একটি ছবি হাজারো শব্দের কথা বলে’। তেমনি একটি বইআড্ডা জ্ঞানের তৃষ্ণা বাড়িয়ে তোলে। জানার আগ্রহ তৈরি করে। এ ধরনের আড্ডা বড্ড আপন মনে হয়। তাইতো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, কাজ ফেলে অনেকে ছুটে আসেন এখানে। বইখেকোদের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে কে না চায়?
আড্ডার পাশাপাশি অনেকে ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিক নিয়ে আলাপ করেন। কেউ কেউ গান গেয়ে সুন্দর সময় উপহার দেন। কারও আবৃত্তি মন ভরিয়ে দেয়। কখনও কখনও কুইজ প্রতিযোগিতা, গল্প বলা, প্রবন্ধ রচনা প্রভৃতি বিষয় চলে আসে এই ছোট্ট ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মাধ্যমে। যেন একজন মায়ের ভূমিকায় থাকে লাইব্রেরিটি।
সদস্যরাও আপনজনের মতো আগলে রাখেন লাইব্রেরিটিকে। প্রতি সপ্তাহে একবার না দেখতে পেলে যেন বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে! লাইব্রেরির বইয়ের সঙ্গে পাঠকের কথা হয়। গভীর মমতায় বই স্পর্শ করে পাঠক। ছোলেমান নবী যেমন পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিটির সদস্যরা যেন তেমনি বোঝেন বইয়ের ভাষা। পাঠকের কাছে বইগুলো যেন জীবন্ত।
ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিটি না থাকলে গ্রামে বসে প্রিয়জনের কাছেও এত কথা লেখার সুযোগ হয়তো পাওয়া যেত না। ছোট্ট একটি লাইব্রেরি; অথচ আমাদের জীবন রাঙিয়ে দিয়েছে। জীবনকে চিনতে শিখিয়েছে জীবনের মতো করে। পথ চলায় এনে দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য। ঘরমুখো ছেলেটিকে বিশ্বপাঠশালায় হাজির করেছে। বলতে শিখিয়েছে, মিশতে শিখিয়েছে। পড়তে শিখিয়েছে, পড়াতেও শিখিয়েছে। তাই স্বপ্নেরা খেলা করে আমাদের ছোট্ট লাইব্রেরি ঘিরে।
বেলাল হোসাইন বিদ্যা, ছাত্র