শেয়ার বিজ ডেস্ক: চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো দেশে ঢুকছে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া কসমেটিকস, গার্মেন্টস পণ্য, শিশুখাদ্য ও বিদেশি সিগারেট। বছর খানেকের বেশি সময় ধরে মন্দা ঠেকাতে সরকার বিলাসদ্রব্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছে। বৈধ আমদানিকারকদের ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানি করতেও বেগ পেতে হচ্ছে । এমনকি দেশের শীর্ষ¯’ানীয় ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে ব্যাংকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হচ্ছে । এর মধ্যেও মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে দেশে ঢুকছে বিলাসপণ্য ও সিগারেটের মতো ক্ষতিকর দ্রব্য। এমনকি বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানির আড়ালেও রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া অবৈধ বিদেশি সিগারেট আমদানির নজির রয়েছে।
রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া এসব পণ্য জাহাজ থেকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে খালাস হয়ে নগরীর রিয়াজু্িদ্দন বাজারের আড়তে আসে। আড়ত থেকে পাইকাররা সংগ্রহ করেন এবং খুচরা বাজারে পৌঁছে দেন। রিয়াজুদ্দিন বাজারের আফজাল হোসেন নামের একজন দোকান কর্মচারী বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে মেয়াদ শেষের দিকে থাকা মালামাল কমমূল্যে সংগ্রহ করে দেশে আনা হয়।’ এসব নামিদামি ব্র্যান্ডের বিদেশি পণ্য বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কমমূল্যে পাওয়া যায় বলে ক্রেতারা আকৃষ্ট হন। অন্যদিকে বন্দর থেকে এগুলো বিশেষভাবে চলে আসে। ফলে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
এছাড়াও কক্সবাজারের মায়ানমার সীমান্ত, খাগড়াছড়ি ও ফেনীর ভারত সীমান্ত এলাকা দিয়ে রাতের আঁধারে প্রচুর পরিমাণের অবৈধ বিদেশি সিগারেট দেশের বাজারে প্রবেশ করছে। এই অবৈধ সিগারেট চোরাচালান ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্ত অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও চোরাইপথে আসা অবৈধ বিদেশি সিগারেটের চালান বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যা ছড়িয়ে পড়ছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় পাইকারি বাজারে।
এসব পণ্য আবার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নাম প্রকাশে অনি”ছুক রিয়াজুদ্দিন বাজারের আরেকজন ডিলারের কর্মচারী জানান, ‘অনেক সময় সমুদ্র পথে আসতে আসতে বিদেশি পণ্যের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তখন আমরা এগুলোতে নতুন সিল মেরে মেয়াদ বাড়িয়ে দিই। প্রসাধনী পণ্যের ক্ষেত্রে মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে চ্যালেঞ্জ থাকলেও সবচেয়ে সুবিধাজনক ও লাভজনক ব্যবসা হলো সিগারেট। এখানে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ থাকে না। তাই সিল মারা বা তোলার ঝামেলা নাই। ক্রেতারা এক বছর পরেও কেনে। নষ্ট হলে বোঝার কিছু নাই। মনে করে বিদেশি সিগারেটের স্বাদ এমনই। শুধু ড্যাম হয়ে গেলে প্রবলেম হয়।’
রিয়াজুদ্দিন বাজারের পানপট্টিতে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিটি দোকানে থরে থরে সাজানো আছে আকর্ষণীয় মোড়কের বিদেশি সিগারেট। ধারণা করা যায়, প্রতিদিন এখানে অন্তত কয়েক শত কোটি টাকার বিদেশি সিগারেট বিক্রি হয়। এসব রাজস্ব ফাঁকির সিগারেট নগরের অলিগলি থেকে শুরু করে পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামেও।
নগরজুড়ে বিক্রি হওয়া এসব অবৈধ বিদেশি সিগারেটে মধ্যে রয়েছে ওরিস, ইজি, মন্ড, গুদাংগ্রাম, এমজি ইত্যাদি। এসব সিগারেটের রয়েছে আবার নানান রকমের ফ্লেভার। শুধু মাত্র ওরিস ব্র্যান্ডের সিগারেট রয়েছে ১২ ধরনের ফ্লেভারের। মন্ড ব্র্যান্ডের সিগারেট রয়েছে ৬/৭ ফ্লেভারের।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, ‘কেউ যাতে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে না পারে এটি নিয়ে এনবিআর কাজ করে। আইন শৃঙ্খলা বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে পুলিশও এসব অপরাধ নির্মূলে কাজ করে যা”েছ। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়ে আমরা বিপুল পরিমাণ চোরাই সিগারেট জব্দ করেছি। অভিযান চালিয়ে নকল ব্র্যান্ডরোল জব্দ করা হয়েছে। সামনেও যাতে কেউ এসব অপরাধ না করতে পারে সেজন্য পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত আছে।’
আকর্ষণীয় মোড়ক আর নানান ফ্লেভারের হওয়ায় অধূমপায়ী তরুণ-তরুনীরাও ঝুঁকছেন এসব ব্র্যান্ডের দিকে। এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় স্কুল শিক্ষক শাহিন আলমের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমাদের তরুণদের ধ্বংস করার জন্য এটা বড় ধরনের ষড়যন্ত্র। দেশের বাজারে কয়েক বছর আগেও এতো রকমের সিগারেট পাওয়া যেতো না। এখন এতো সুন্দর প্যাকেট, এতো এতো ফ্লেভার দেখলে তো আমাদের শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হবেই। বিশ্বব্যাপী যেখানে তামাক নিয়ন্ত্রণের কথা হচ্ছে সেখানে আমাদের দেশে এতো বিদেশি সিগারেট ঢোকে কীভাবে?’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিগারেট আমদানিতে ৫৯৬ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স দিতে হয়। আর বাংলাদেশের বাজারে বিক্রয় করতে হলে প্যাকেটের গায়ে অবশ্যই স্বাস্থ্য সতর্কবাণী সংবলিত ছবি ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন পণ্য জনস্বার্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। অথচ দেশের বাজারে দেদারসে ঢুকছে এসব মানহীন পণ্য।
চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন,‘আমরা সম্প্রতি অবৈধ সিগারেট বিক্রয়ে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি অবৈধ সিগারেট বিক্রয়ের মূল হোতাকে আটক করতে।’
গত কয়েক মাসে অবৈধ বিদেশি সিগারেট আটকে দেশের সীমান্ত অঞ্চলে বেশকয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছে আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা। তবে অভিযান পরিচালনার পরও আড়ালে থেকে যা” অবৈধ বিদেশি সিগারেট আমদানির বড় একটি অংশ। যে কারণে চট্টগ্রাম বাজারসহ সর্বত্রই প্রসারিত হচ্ছে অবৈধ বিদেশি সিগারেটের বাজার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবৈধ বিদেশি সিগারেট আমদানির আড়ালে প্রতিবছর দেশ থেকে পাচার হচ্ছে শত শত কোটি টাকা।