আজ ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। মুসলিমদের জন্য যুগপৎ আনন্দ ও দুঃখের দিন। মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতে, এ দিনটি একই সঙ্গে প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম দিন ও ওফাত দিবস। আর একে ঘিরে গড়ে ওঠা উৎসবের নাম ঈদে মিলাদুন্নবী। অবশ্য দিনটি বাংলাদেশসহ এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয় যতটা গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়, অনেক দেশেই তা হয় না। কেউ কেউ একে বেদাত (কোরআন-হাদিসের বাইরে নতুন উদ্ভাবন) আখ্যা দিয়ে এড়িয়ে যান। তবে সিংহভাগ সুন্নি ও প্রায় সব শিয়া পণ্ডিতের মতে, ঈদে মিলাদুন্নবী পালন সমর্থনযোগ্য এবং এটি বেদাতে হাসানা (উত্তম উদ্ভাবন)। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন, প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে যেসব অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার জীবন্ত রোল মডেল হচ্ছেন মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)। সুতরাং বিশেষ দিবসে এমন ব্যক্তিত্বের স্মরণে এটিই কামনা যে, মিলাদুন্নবীর শিক্ষা প্রতিফলিত হোক প্রত্যেক মুসলিমের জীবন ও কর্মে।
মহানবী (সা.)-এর জীবনালোচনায় দৃষ্টি না দিয়ে পারা যায় না যেখানে ২৩ বছরের নবুওতি জীবনের পাশাপাশি তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত ছিলেন ২৫ বছর। তাছাড়া নবী হিসেবে দরিদ্রের মতো জীবনযাপন করলেও ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর সাফল্য অবিসংবাদিত। লক্ষণীয়, তাঁর ব্যবসায়িক জীবনের সূচনা চাচা আবু তালিবের হাত ধরে। সেখানে দীর্ঘদিন শিক্ষানবিশ (ইন্টার্নশিপে) ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে মক্কায় সমাদৃত ব্যবসা ব্যবস্থাপকে (বিশেষত জাজিরাতুল আরবের ঐতিহ্যবাহী ওকাজ মেলা চলাকালে) পরিণত হন। জীবনের একপর্যায়ে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক, ব্যবসার মালিক ও বিনিয়োগকারী হন তিনি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই যে তাকে আল-আমিন (বিশ্বাসী) নামে ডাকতেন, সেটা মূলত ব্যবসায়িক অনুশীলনে তাঁর দৃষ্টান্তমূলক সততার জন্যই। ফলে তাঁর প্রচারিত বাণীতে ব্যবসায় সততা চর্চা, মনোপলির কুফল ও বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি বিষয় গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মতো ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা ও একই সঙ্গে ধর্মপ্রচারক মানবেতিহাসে বিরল। দুঃখজনক হলো, এমন একজন মহান ব্যক্তির প্রচারিত ধর্মের অনুসারী হয়েও মুসলিমদের মধ্যে তাঁর অনুসৃত ব্যবসায়িক অনুশীলন পরিপালনের নিদর্শন কম। অনেকে যেখানে পুণ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত সুন্নতও অনুসরণ করে থাকেন, সেখানে ব্যবসাক্ষেত্রে কয়জন মুসলিম মহানবী (সা.)-এর সুস্পষ্ট দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করেন, তা পর্যবেক্ষণের বিষয়।
লক্ষণীয়, মহানবী তাঁর জীবনে তৎকালীন আরববিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ভ্রমণ করেছেন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। তাঁর অন্যতম জীবন-দর্শন ছিল, ব্যবসায়িক উদ্যোগ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে ও দারিদ্র্য কমায়। আরও খেয়াল করার বিষয়, এই ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি জোর দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর; যে আচরণ তাঁর ওফাতের পরও কয়েক দশক পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করে আসছিলেন মুসলিম নেতারা। কথা হলো, একবিংশ শতাব্দীর চলমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রয়োজনীয়তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে তীব্র বলেই অনুভূত। কিন্তু মুসলিমদের এ চাহিদাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দ্বারা আহত এবং কিছু ক্ষেত্রে বর্ণবাদের রোষানলে দগ্ধ। আরও দুর্ভাগ্যজনক, পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বর্তমান মুসলিম নেতাদের গৃহীত উদ্যোগ চলতি চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে আমরা আশা করি, বাংলাদেশসহ সব মুসলিম দেশের আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে মহানবীর জীবন-শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়াতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবেন মুসলিম নেতারা।
Add Comment