নয়ন খন্দকার, ঝিনাইদহ : দীর্ঘমেয়াদি ফসল চাষে প্রান্তিক চাষিদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মিল থেকে ঋণ নিয়ে আখ চাষ না করে অন্য ফসল রোপণ করাসহ নানা ধরনের কারণে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ সুগারমিলের আওতাধীন ছয়টি সাব জোনে দিন দিন আখ চাষ কমে যাচ্ছে। সুগার মিলের বিগত কয়েক বছরের চিত্রে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০২২-২৩ মৌসুমে চাষিদের চার কোটি ৭২ লাখ টাকার ঋণ প্রদান ও আখের মূল্য বৃদ্ধি করার পরও আখ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা অজিত হয়নি। ফলে চলতি ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌসুমে সুগারমিলটিকে কোটি কোটি টাকার লোকসান গুনতে হবে বলে মিলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ধারণা করছেন।
চলতি মাড়াই মৌসুমে এবার ৫০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে তিন হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আহরণের গড় হার ছয় শতাংশ পরিমাণ ধরা হয়েছে। আর আখের মূল্য মণপ্রতি ধরা হয়েছে ২২০ টাকা। চলতি বছর যে আখ আছে, তা দিয়ে মিলটি ৪০ দিন চলবে।
দিন দিন আখ চাষ কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে মোবারকগঞ্জ সুগারমিলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার বলেন, দীর্ঘমেয়াদি ফসল চাষে প্রান্তিক চাষিদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং স্বল্পমেয়াদি লাভজনক ফসল চাষে আগ্রহী হওয়ায় কারণে আখ চাষ কমে যাচ্ছে। এছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তন এবং মিল থেকে ঋণ নিয়ে চাষিরা অন্য ফসল আবাদ করছেন, যার কারণে আখ চাষ আগের মতো হচ্ছে না।
তবে আখচাষিদের কথা বিবেচনা করে আখের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২০-২১ মৌসুমে আখের মূল্য মণপ্রতি ছিল ১৪০ টাকা, সেটা বাড়িয়ে ২০২৩-২৪ মৌসুমে ২২০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া আগামী ২০২৪-২৫ মৌসুমে আরও ২০ টাকা বাড়িয়ে আখের মণপ্রতি ক্রয়মূল্য ২৪০ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া আখচাষিদের আখ চাষে নানা প্রকার ভর্তুকি ও মিল থেকে ঋণ দেয়া হচ্ছে। আশা করি আগামী মৌসুম থেকে মিলটিতে আখ ও চিনি উৎপাদন বাড়বে। মিলটি বেশি দিন চলবে।
তিনি আরও জানান, সুগারমিলটিতে আগে আটটি সাবজোন ছিল। বর্তমানে সেটি কমিয়ে ছয়টি (যশোর-চৌগাছা, ঝিনাইদহ-হরিণাকুণ্ডু, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, মিলগেট-এ ও মিলগেট-বি) সাবজোনে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি সাবজোনে দুই উপসহকারী কর্মকর্তা ছিলেন, এখন এক কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়া ইউনিট পর্যায়ে রয়েছেন এক সিডিএ। তারা সার্বক্ষণিকভাবে কৃষকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, দলীয় সভা, উঠান বৈঠাক, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ ও মাইকিংয়ের মাধ্যমে কাউন্সিলিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার খামার মন্দিয়া গ্রামের আখচাষি দলিল উদ্দীন বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর আখের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় আমরা অনেক খুশি। আমার দুই বিঘা জমিতে আখ চাষ রয়েছে। মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় আরও দুই বিঘা জমিতে নতুন করে চাষ করব। দাম বাড়ার কারণে এলাকার অনেক কৃষক নতুন করে আবার আখ চাষ শুরু করেছেন।’
মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ইউানয়নের সভাপতি গোলাম রসুল জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে মিলটির পরিবেশ ভালো ছিল না। দিন দিন আখ চাষ কমে যাওয়ায় মিলটি গত মৌসুমে মাত্র ২৮ দিন চলেছে। সেই অবস্থা থেকে মিলটি এখন সুদিনে ফিরছে। চলতি ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌসুমে ৪০ কার্যদিবসে ৫০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে তিন হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর থেকে চলতি বছর মিলটি ১২ দিন বেশি চলবে। আগামী ২০২৪-২৫ মৌসুমে মিলটিতে আরও বেশি আখ রোপণ করা হবে এবং অনেক দিন মিলটি চলবে। দেশের অধিকাংশ সুগার মিল বন্ধ হয়ে গেলেও মোবারকগঞ্জ সুগারমিলটি বাঁচিয়ে রাখতে আমরা আখ চাষ বৃদ্ধি করছি।
তিনি আরও জানান, আগে ঠিকমতো চিনি বিক্রি হতো না, যার কারণে আখচাষিদের আখের টাকা পরিশোধ করতে দেরি হতো। এছাড়া তিন-চার মাস অতিবাহিত হলেও শ্রমিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করত। কিন্তু মিলের সেই অবস্থা এখন আর নেই। কারও বেতন ভাতা এখন আর বাকি থাকে না।
মোবারকগঞ্জ সুগারমিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, আখ চাষ বৃদ্ধির জন্য আখের নতুন মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে। বিগত মৌসুমে আখের মূল্য ছিল ১৮০ টাকা। চলতি মৌসুমে সেটা বাড়িয়ে আখের মণপ্রতি ক্রয়মূল্য করা হয়েছে ২২০ টাকা। এছাড়া আগামী ২০২৪-২৫ মৌসুমে ছয় হাজার একর জমিতে আখ রোপণ করে এক লাখ মেট্রিক টন আখ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী মৌসুমে আখের মূল্য আরও ২০ টাকা বাড়িয়ে ২৪০ নির্ধারণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আখ চাষ বৃদ্ধির জন্য চাষিদের সাথী ফসলের সঙ্গে আখ চাষ করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া নগদ অর্থসহ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র থেকে সার, বীজ, নগদ অর্থ ও প্রদর্শনী প্লট করে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে স্বল্প সুদে মিল থেকে তাদের ঋণও দেয়া হয়।