মুক্তবাজার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল

এম খালেক: বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলছে মুক্তবাজার অর্থনীতির জয়-জয়কার। একসময় যারা সমাজতন্ত্রের নামে সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি অনুসরণ করতো, এখন তারা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি ধারণ করছে। ফলে বিশ্বব্যাপী সংরক্ষণবাদী অর্থনীতি চালু নেই বললেই চলে। গত শতাব্দীর ৯০’র দশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) গঠিত হওয়ার পর থেকেই মুক্তবাজার অর্থনীতি চালুর তোড়জোড় শুরু হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্য দাতা সংস্থাগুলো বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে। ফলে কোনো দেশ মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত তারা দাতা সংস্থাগুলোর চাপে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। কারণ দাতারা অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত হিসেবে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালুর কথা বলে। ফলে এ ব্যবস্থা অনুসরণে বাধ্য হয় উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো। কারণ শর্ত না মানলে সহায়তা পাওয়া যাবে না। তাই ‘অনুরোধে ঢেঁকি গেলা’র মতো মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণে বাধ্য হয়। যদিও প্রাথমিকভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনেক দেশের জন্য মঙ্গলজনক ছিল না। এছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতি পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা না গেলে এর সুফল পাওয়া যায় না। মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণের পর অনেক উন্নয়নশীল দেশেরই অর্থনৈতিক অবস্থা আগের তুলনায় খারাপ হয়ে গেছে।

অনেক দেশই দাতাদের চাপে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করলেও একই সঙ্গে সংরক্ষণবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও অনুসরণ করে চলেছে। অর্থাৎ তারা অনেকটা মিশ্র অর্থনীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশও এমন একটি দেশ, যারা মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করছে শুরু থেকেই। কিন্তু এখনও পরিপূর্ণ মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করতে পারেনি। ফলে আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে পারছি না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে সম্প্রতি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ অর্থনীতি চালুর ক্ষেত্রে কোন দেশ কেমন সফলতা দেখিয়েছে, এতে তা তুলে ধরা হয়েছে। ‘ওপেন মার্কেট ইনডেক্স ২০১৭’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে ৭৫টি দেশের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। সংস্থাটি ২০১১ সাল থেকে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এটি তাদের চতুর্থ প্রতিবেদন। দেশের অর্থনীতির বাণিজ্য উম্মুতা, বাণিজ্য-নীতি ব্যবস্থা, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগবিষয়ক উদার নীতি ও বাণিজ্যসহায়ক অবকাঠামো এ চার মানদণ্ডে একটি দেশের অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। এসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে ১ থেকে ৬ নম্বরের মধ্যে স্কোরিং করা হয় দেশগুলোকে। প্রতিবেদনভুক্ত দেশগুলোর গড় স্কোর এসেছে তিন দশমিক ছয়। বাংলাদেশের স্কোর গড় স্কোরের চেয়েও কম। স্কোরের ভিত্তিতে দেশগুলোকে পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ক্যাটাগরিতে পড়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৭০তম। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে আমরা এ ব্যবস্থার সুফল ভোগ করতে পারছি না।

মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল কথাই হচ্ছে, সেখানে কোনো সংরক্ষণবাদী ব্যবস্থা থাকবে না। কোনো প্রতিষ্ঠানকে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ ও অধিকার দেবে না সরকার বা রাষ্ট্র। বরং বাজারে পূর্ণাঙ্গ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকবে। যোগ্যতর প্রতিষ্ঠানই টিকে থাকবে। ক্রেতা বা ভোক্তার চাহিদার ওপর নির্ভর করেই কোনো পণ্যের বাজারদর নির্ধারিত হবে। পণ্য সরবরাহ বা মূল্য নির্ধারণে রাষ্ট্রের তেমন কোনো ভ‚মিকা থাকবে না। বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা বিরাজ করবে। বাজারই নির্ধারণ করবে কোন পণ্য বাজারে আসবে এবং সেটির মূল্য কত হবে। কাউকেই বাজারে পণ্য বা সেবা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া যাবে না। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করা গেলে সেখানে ভোক্তার সার্বভৌমত্ব সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ ভোক্তা কোনো বিশেষ উৎপাদন বা সরবরাহকারীর কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে না। তিনি ইচ্ছা করলে এক ব্যক্তি বা সরবরাহকারীর কাছ থেকে পণ্য বা সেবা না কিনে অন্য বিক্রেতার কাছ থেকে কিনতে পারবেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একসময় আমাদের দেশে কোনো মোবাইল ফোন বা সেলফোন ছিল না। তখন টিঅ্যান্ডটির ল্যান্ডফোনই ছিল একমাত্র ভরসা। আমি ২০০০ সালে একটি ল্যান্ডফোন সংযোগের জন্য আবেদন করি। তৎকালীন টিঅ্যান্ডটিমন্ত্রীকে দিয়ে আবেদনপত্রে সুপারিশ করাই। তারপর টেলিফোন বিভাগের একজন পরিচালককে দিয়ে আমার নামে ডিমান্ড নোট ইস্যু করাতে সক্ষম হই। ডিমান্ড নোটের টাকা ও  ফোনসেটের মূল্য বাবদ ২০ হাজার ২০০ টাকা জমা দিয়েও দিনের পর দিন ঘুরতে থাকি সংযোগের আশায়। কিন্তু সংযোগ আর দেওয়া হয় না। প্রায় এক বছর পর সংযোগ পাই। যেহেতু টিঅ্যান্ডটির ল্যান্ডফোনের কোনো বিকল্প ছিল না, তাই সেখান থেকেই ফোন সংযোগ নিতে হয়। পরবর্তীকালের ইতিহাস সবারই জানা। দেশে বেশ কয়েকটি মোবাইল কোম্পানিকে মোবাইল ফোন সংযোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষ টিঅ্যান্ডটি (বর্তমানে বিটিসিএল) থেকে ল্যান্ডফোন সংযোগ নেওয়ার তেমন একটা প্রয়োজন বোধ করছে না। কারণ মোবাইল ফোন সংযোগ পেতে কোনো কষ্ট করতে হয় না। এছাড়া এর ব্যবহার পদ্ধতিও খুবই সহজ। যে কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। বিটিসিএল এখন রাজধানীতে ল্যান্ডফোন সংযোগ ফি নির্ধারণ করেছে দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে এক হাজার টাকা জামানত। রাজধানীর বাইরে সংযোগ নিতে ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা দিতে হয়। আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। তারপরও তারা গ্রাহক পাচ্ছে না। এটাই মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে একান্ত জরুরি কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য সব প্রতিষ্ঠানই ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যার রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থকরা মনে করেন, রাষ্ট্র কখনও ভালো ব্যবসায়ী হতে পারে না। তাই অত্যাবশ্যকীয় দু’একটি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত কোনো প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকা উচিত নয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টি করা। অবকাঠামো গড়ে দেওয়া। সে সুবিধা কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি তার সৃজনশীলতার সর্বোত্তম ব্যবহার করে উৎপাদনকার্য পরিচালনা করবে। রাষ্ট্র কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গেলে সেখানে দুর্নীতি ও অদক্ষতা দানা বাঁধতে পারে। কারণ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় প্রতিনিধির মাধ্যমে। মালিক সেখানে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থাকেন না। ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের দরদ থাকে খুবই কম। বরং নিজেদের আখের গোছানোর প্রচেষ্টা সেখানে লক্ষণীয়। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সরাসরি মালিকের তত্তাবধানে পরিচালিত হয় বলে সেখানে সততা ও জবাবদিহিতা থাকে সর্বোচ্চ মাত্রায়। মালিক সব সময় চেষ্টা করেন কীভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে বা প্রটেকশনে কোনো উৎপাদন-যন্ত্র থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের এখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইতিপূর্বে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরের কার্যক্রম চলছিল। বর্তমানে তা বন্ধ আছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো দিনের পর দিন লোকসান দিয়ে চলেছে। আর জাতি হিসেবে আমরা তার দায়ভার বহন করে চলেছি। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইতিপূর্বে শোনা গিয়েছিল, সরকারি উদ্যোগে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে যেগুলো পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিমালিকানাধীনে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু তা করা হয়নি। দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের দুরবস্থা চরমে পৌঁছেছে। অদক্ষতা ও অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবে ব্যাংকগুলো ডুবতে বসেছে। সরকার প্রতি বছর এসব ব্যাংকের জন্য মূলধন জোগান দিয়ে চলেছে। কিন্তু এতগুলো ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রেখে অবশিষ্টগুলো ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা যেতে পারে। এটা করা হলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো তুলনামূলক ভালো চলতে পারে। সরকারকেও প্রতি বছর এদের জন্য মূলধন জোগান দিতে হবে না। তাদের বলে দেওয়া যেতে পারে যেসব ব্যাংক লাভজনকভাবে চলতে পারবে না, তাদের ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হবে।

শুধু ব্যাংকের কথাই বা বলি কেন? রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে থাকা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রুত ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। আর সেটা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে ব্যক্তিমালিকানাধীনে একই জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়াসহ পুঁজি প্রবাহ অবাধ করা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিসাপেক্ষে সীমিত পরিমাণে বিনিয়োগ করা যায়। এটা অবারিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা যদি বাইরে লাভজনকভাবে বিনিয়োগের সুযোগ পান, তাহলে কেন তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে না? এটা মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল সূত্রের পরিপন্থি। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই অবাধ প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখের প্রয়োজন, তাহলো মুক্তবাজার অর্থনীতির যারা প্রবক্তা, তারা নিজেরাই এর মূল সূত্র থেকে দূরে রয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে বাজার অর্থনীতি চালু আছে, তা মূলত পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্যান্য ক্ষেত্রে এটা তেমন একটা প্রযোজ্য নেই। যেমন উৎপাদনের মূল যে উপকরণ মানুষ বা জনশক্তি, তার অবাধ চলাচলের কোনো ব্যবস্থা এতে রাখা হয়নি। উন্নত দেশগুলো জানে, তাদের সঙ্গে পণ্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলো কখনই কুলিয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু জনশক্তির অবাধ চলাচল সুবিধা দেওয়া হলে সেটা তাদের জন্য অসুবিধাজনক হবে। তাই তারা কৌশলে জনশক্তির অবাধ চলাচল মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেনি। এছাড়া পুঁজির অবাধ প্রবাহের ক্ষেত্রেও তাদের রয়েছে আপত্তি। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। মুক্তবাজার অর্থনীতি যদি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা না হয়, তাহলে সেটা কোনোভাবেই সুফল দিতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর এখন সে দাবি উত্থাপন প্রয়োজন।

 

অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০