কেবল উদরপূর্তিই নয়, খাওয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা বরাবরই ছিল, আছে বাঙালির চিন্তায়, রুচিতে। খাওয়ার পদবৈচিত্র্য তাই এ জনপদজুড়ে। দেশের নানা স্থানের বিশেষ বিশেষ খাবারের কথা জানাচ্ছেন মীর মাইনুল ইসলাম
বাহারি মিষ্টান্ন তৈরিতে বিশ্বজুড়ে সুখ্যাতি রয়েছে বাঙালির। দেশের নানা জেলায় মিষ্টান্ন তৈরির নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। স্বাদেও রয়েছে ভিন্নতা। তেমনি একটি দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন ‘মণ্ডা’। ‘মুক্তাগাছার মণ্ডা’ নামে যা বেশি পরিচিত। স্বাদ ও গুণের কারণে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও।
মণ্ডার ইতিহাস
ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে মুক্তাগাছা উপজেলা। এখানকার মণ্ডা নিয়ে একটি বিখ্যাত গল্প প্রচলিত আছে। স্থানীয়দের মতে, প্রায় দুইশ’ বছর আগে সেখানকার গোপাল পাল এক রাতে স্বপ্নাদিষ্ট হন। তিনি স্বপ্নে দেখেন, শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে এক ঋষি তাকে মণ্ডা তৈরির আদেশ দিচ্ছেন। ঋষির আদেশ অনুসারে পরের দিন চুল্লি খনন শুরু করেন তিনি। এ সময় হঠাৎ উদয় হন সেই ঋষি। তিনি হাত বুলিয়ে দিলেন গোপালের সেই চুল্লিতে। নিজের হাতে গোপালকে মণ্ডা তৈরির কলাকৌশল শিখিয়ে দেন। দুধ ও চিনির মিশ্রণে মণ্ডা তৈরি করে ফেলেন গোপাল। এরপর তা পরিবেশন করেন তৎকালীন মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর রাজ দরবারে। মণ্ডার স্বাদ আস্বাদন করে মহারাজা বেজায় খুশি হন। সুস্বাদু মিষ্টান্নের জন্য বাহবা দেন গোপালকে। এ ঘটনার পর মণ্ডার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
বাংলা ১২০৬ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন গোপাল পাল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর গোপাল রাজশাহীতে চলে আসেন। পরে বাংলা ১২৩০ সালে তিনি মুক্তাগাছায় এসে বসবাস শুরু করেন। ধারণা করা হয় প্রথম মণ্ডা তৈরি করা হয়েছিল বাংলা ১২৩১ সালে।
উপাদান
মণ্ডার মূল উপাদান দুধ ও চিনি। চ্যাপ্টা আকৃতির মিষ্টান্নটি ছানা ও চিনির রসায়নে প্রস্তুতকৃত এক ধরনের সন্দেশ। এর প্রস্তুত প্রণালি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। কেননা, মণ্ডা তৈরির প্রক্রিয়া গোপন রাখা হয়েছে। গোপাল পালের বংশধররা এটা তৈরি করে থাকেন। এমনকি যেখানে তৈরি হয়, বাড়ির নারীরাও সেখানে যেতে পারেন না। পূর্বপুরুষের আদেশ মেনেই এ রীতি পালন করে আসছেন মণ্ডার কারিগররা।
সাধারণত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয় না মণ্ডা। এটি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গরমের সময় তিন থেকে চারদিন ও শীত মৌসুমে দশ থেকে বারো দিন ভালো থাকে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান কৃষ্ণ রায়, রাশিয়ার কমরেড জোসেফ স্ট্যালিন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সরোদ বাদক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁসহ অনেক গুণী মানুষ এ মিষ্টান্নের প্রশংসা করেছেন।
দেশের নানা জায়গায় মণ্ডা নামে মিষ্টান্ন বিক্রি হয়ে থাকে। তবে আসল স্বাদ পাওয়ার জন্য আপনাকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় যেতে হবে। সেখানেই পাবেন গোপাল পালের আদি মণ্ডা।
Add Comment