কাজী সালমা সুলতানা: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়েরের ৫৪তম বার্ষিকী আজ। ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয়, শেখ মুজিব ও অন্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং মামলা’। কিন্তু এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবেই বেশি পরিচিত।
এই মামলাটি দায়ের করার আগে ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী, রাজনৈতিক এবং সরকারি কর্মকর্তা মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্য থেকে ৩৫ জনকে আসামি করে তাদের বিরুদ্ধে ১০০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উল্লেখ করে মামলা দায়ের করে তৎকালীন সরকার। বাঙালি জাতির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয় ১ নম্বর আসামি। বাকি ৩৪ আসামির সবাই ছিল সামরিক বাহিনীর সদস্য। বাকি আসামিরা হলেনÑআহমেদ ফজলুর রহমান (সিএসপি অফিসার), কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, সাবেক এলএস সুলতানউদ্দীন আহমদ, এলএসসিডিআই নূর মোহাম্মদ, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজ উল্লাহ, করপোরাল আবদুস সামাদ, সাবেক হাবিল দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্দুস (সিএসপি অফিসার), ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক, বিভূতিভূষণ চৌধুরী (ওরফে মানিক চৌধুরী), বিধান কৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, সাবেক কেরানি মুজিবুর রহমান, সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. আব্দুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, এ.বি. খুরশীদ, খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান (সিএসপি অফিসার), একেএম শামসুল হক, হাবিলদার আজিজুল হক, মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শামসুল হক, শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মো. আব্দুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন এ. শওকত আলী, ক্যাপ্টেন খোন্দকার নাজমুল হুদা, ক্যাপ্টেন এ. এন. এম নূরুজ্জামান, সার্জেন্ট আবদুল জলিল, মাহবুবু উদ্দীন চৌধুরী, লে. এম রহমান, সাবেক সুবেদার তাজুল ইসলাম, আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দীন এবং ল্যা. আবদুর রউফ। একই অভিযোগে আগে থেকেই জেলে আটক থাকা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে ১৭ জানুয়ারি পুনরায় গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জবানিতে বলেন, ‘প্রায় ২১ মাস আটক রাখিবার পর ১৯৬৮ সালের ১৭/১৮ তারিখে রাত ১টার সময় আমাকে তথাকথিত মুক্তি দেওয়া হয় এবং কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক হইতে কতিপয় সামরিক ব্যক্তি দৈহিক বল প্রয়োগ করিয়া আমাকে ঢাকা সেনানিবাসে লইয়া আসে এবং একটি রুদ্ধ কক্ষে আটক রাখে। আমাকে বহির্জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নির্জনে রাখা হয় এবং কাহারো সহিত সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়। আমাকে খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়িতে দেওয়া হইত না, বিশ্ব হইতে সকল যোগাযোগবিহীন অবস্থায় এইভাবে আমাকে দীর্ঘ পাঁচ মাসকাল আটক থাকিতে হয়। এই সময় আমাকে অমানুষিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় এবং আমাকে সকল প্রকার দৈহিক সুযোগ-সুবিধা হইতে বঞ্চিত রাখা হয়।
এই মামলাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। পাকিস্তানি শাসক ১৭নং অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১১নং অভিযুক্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে কারাগারের ভেতরে গুলি করলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদ, ২৪ জানুয়ারি মতিউর এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা শহিদ হন। এই অভ্যুত্থানে সারাদেশে প্রায় ৫৮ জন শহিদ এবং শত শত মানুষ আহত হন।
গণআন্দোলনের মুখে আইযুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়াারি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। ঐতিহাসিকরা এই মামলা এবং মামলা থেকে সৃষ্ট গণ-আন্দোলনকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে প্রেরণাদানকারী অন্যতম প্রধান ঘটনা বলে মনে করেন।
গণমাধ্যমকর্মী
salma15august@gmail.com